ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে চীনের অস্ত্র

কর্তৃক porosh
০ কমেন্ট 29 ভিউস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

কয়েক দশক ধরে চীনের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে আসছে রাশিয়া। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চীনের কাছে প্রতিবছর গড়ে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে রাশিয়া। ২০১৫ সালে তারা চীনের সঙ্গে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি অস্ত্র চুক্তি করে। কিন্তু এখন ঘটনা উল্টে গেছে। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে রাশিয়া ৯ হাজার ৪০০ যুদ্ধ সরঞ্জাম খুইয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৫০০টি ট্যাংক। এ ছাড়া এক বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে গোলাবারুদের সংকটে পড়েছে মস্কো।

মার্কিন গোয়েন্দাদের ধারণা, রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের কথা ভাবছে বেইজিং। যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, চীন যদি রাশিয়াকে অস্ত্র দেয়, তবে যুদ্ধের গতি পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে গভীর সংকট তৈরি হবে।

তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক এমনিতেই ভালো নয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা বেলুন শনাক্ত হওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে শুরু হয়েছে কথার লড়াই। এর মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বৈঠক করে রাশিয়াকে শায়েস্তা করার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে চীনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, রাশিয়াকে অস্ত্র দিলে চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। চীনের পক্ষ থেকে অবশ্য রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের কথা স্বীকার করা হয়নি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চীনকে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ ও ভারসাম্য তৈরিতে বড় সুযোগ করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রুশ সামরিক প্রযুক্তি আমদানি করেছে দেশটি।

ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু পর থেকে চীনের কাছ থেকে একাধিকবার অস্ত্র সহায়তা চেয়েছে মস্কো। চীন বারবার মস্কোকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এত দিন পর্যন্ত কেবল প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে। চীনের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে দেওয়া সহায়তার মধ্যে রয়েছে হেলমেট ও উড়োজাহাজের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে কোন ধরনের অস্ত্র সহায়তা দেওয়া হতে পারে, সে বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা বিস্তারিত কিছু বলেননি। তবে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জার্মান ম্যাগাজিন ডের স্পিগেল দাবি করে, চীনের কাছ থেকে ড্রোন পেতে আলোচনা করেছে রুশ বাহিনী।

ড্রোন নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে দর–কষাকষি চলছে রাশিয়ার। চীনের বিংগো ইনটেলিজেন্ট অ্যাভিয়েশন টেকনোলজি আক্রমণের কাজে ব্যবহার করা যায়, এমন ড্রোন তৈরি করে থাকে। এ ড্রোন পেতেই চেষ্টা করছে রুশ বাহিনী। যুদ্ধক্ষেত্রে ইতিমধ্যে গত সেপ্টেম্বর থেকে এ ধরনের ড্রোন ব্যবহার করে আসছেন রুশ সেনারা। বিশেষ করে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে হামলার কাজে ড্রোনের ব্যবহার দেখা গেছে। ইউক্রেনের অভিযোগ, এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে ইরানের কাছ থেকে পাওয়া ড্রোন ব্যবহার করেছে রুশ বাহিনী।

ডের স্পিগেলের প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বরাতে জানায়, মস্কোকে গোলা সরবরাহের কথা ভাবছে বেইজিং। যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় পক্ষই সোভিয়েত যুগের ক্যালিবার ১২২ এমএম ও ১৫২ এমএম শেল ব্যবহার করে আসছে। তবে এক বছর ধরে চলা এ যুদ্ধে রাশিয়ার গোলা ফুরিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে দেশটি বেলারুশে যে গোলার মজুত রেখেছিল, তা–ও শেষ করে ফেলেছে। উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে কিছু গোলাবারুদ পেয়েছিল। কিন্তু উত্তর কোরিয়া নিজেদের গোলাবারুদ নিঃশেষ করে ফেলা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ইরানের কাছ থেকেও খুব বেশি কিছু পাওয়ার আশা নেই মস্কোর।

এখন মস্কোর ভরসার নাম চীন। তাদের কাছে যথেষ্ট গোলা রয়েছে। পেন্টাগনের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা লোনি হেনলি বলেন, চীনের কাছে ঠিক কী পরিমাণ গোলা আছে, সে সম্পর্কে খুব বেশি জানা সম্ভব নয়। তবে তা অবশ্যই রাশিয়ার গোলা সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট হবে। বর্তমান সংঘাতে বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে এই গোলা। উভয় পক্ষেরই প্রতিরক্ষা খাত উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

বর্তমান সংঘাত বিবেচনায় চীনের অস্ত্র বাণিজ্যের সম্ভাবনা ব্যাপক। বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ চীন। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ র‌্যাংকিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চীনের আটটি স্থান করে নিয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ২০টির মধ্যে রয়েছে চীনের ৭টি প্রতিষ্ঠানটি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীনের অবস্থান। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের শীর্ষ অস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি সরঞ্জাম বিক্রি ব্যাপক বেড়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চীনকে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ ও ভারসাম্য তৈরিতে বড় সুযোগ করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রুশ সামরিক প্রযুক্তি আমদানি করেছে দেশটি। এখন পাল্টা প্রযুক্তি রপ্তানি করে রুশ অস্ত্রের ব্যবহার কমাতে পারবে দেশটি। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চীনের ৮১ শতাংশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এসেছে রাশিয়া থেকে। এর মধ্যে চীনের সাম্প্রতিক সময়ের তৈরি স্টেলথ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিনও রয়েছে।

সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষক মাইকেল রাস্কা বলেন, চীনের জন্য রুশ প্রতিরক্ষা শিল্পের সমঅংশীদার হওয়ার সুযোগ এসেছে চীনের সামনে। রাশিয়ায় দরকারি সরঞ্জাম পাঠানোর পরিবর্তে ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং উন্নত অস্ত্রের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম পাঠিয়ে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠতে রাশিয়াকে সাহায্য করতে পারে চীন। এর পরিবর্তে রাশিয়ার কাছ থেকে আরডি-১৮০ নামের রকেট ইঞ্জিন চাইতে পারে চীন। এ ছাড়া সাবমেরিন প্রযুক্তি ও জেট ইঞ্জিন নিয়েও দর–কষাকষি হতে পারে।

যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে চীনের নেতারা নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন। তারপরও তাঁরা চাইবেন না যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া অপদস্থ হোক। অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের রকেট লঞ্চার ও ইউরোপীয় ট্যাংকের কাছে রাশিয়ার অপদস্থ হওয়া চীন মেনে নেবে না। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগেই সে ইঙ্গিত মিলেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুই দেশের মধ্যে ‘অসীম বন্ধুত্বের’ ঘোষণা দিয়েছিলেন। বেইজিংয়ের কিছু নেতা অবশ্যই চাইবেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও ইউরোপ থেকে দূরে থাকুক।

তবে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্কের মধ্যে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। চীন ইতিমধ্যে ক্রেমলিনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে। মস্কোকে অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, তা নিয়ে বেইজিং ক্ষোভ জানিয়েছে বলে দাবি করেছে ইউরোপের এক কর্মকর্তা। সহযোগিতার বিষয়টি গোপন রাখতে চায় চীন। তা না হলে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ২৪ ফেব্রুয়ারি চীনের পক্ষ থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যে শান্তি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে ইউক্রেনের মিত্ররা। রাশিয়াকে সহযোগিতার বিষয়টি জানাজানি হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বিষাক্ত হয়ে উঠবে এবং ইউরোপের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট হবে।

জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল সতর্ক করে বলেন, রাশিয়াকে মরণঘাতী অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টি হচ্ছে ‘রেড লাইন’ বা সীমারেখা অতিক্রম।

চীন বেশ সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে। বোরেল বলেন, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে এক বৈঠকে বলেছেন, চীন রাশিয়াকে কোনো অস্ত্র দেবে না। তিনি আরও বলেছেন, যুদ্ধরত কোনো দেশে অস্ত্র পাঠায় না চীন। ২৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এ কথাটি আত্মবিশ্বাসের সুরেই বলেছেন, ওয়াং ই তাঁর কথা রাখবেন।

ধারণা করা হচ্ছে আগামী বসন্ত বা গ্রীষ্মে রুশ বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা চালাবে ইউক্রেনের বাহিনী। যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যদি মরিয়া হয়ে ওঠে, তবে চীনের সহনশীলতা তীব্র চাপের মুখে পড়বে।

ইকোনমিস্ট, এএফপি ও রয়টার্স অবলম্বনে

রিলেটেড পোস্ট

মতামত দিন

error: Content is protected !!