কামরুল হাসান/আরিফুল ইসলাম:
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় একই পরিবারের ৪ জনকে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) ভোর রাতে উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নের খলসি গ্রামে হত্যার এ লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানা গেছে। নিহতরা হলেন, খলসি গ্রামের শাহাজান আলীর ছেলে মৎস্য চাষী শাহিনুর রহমান (৪১), তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন (৩২), ছেলে সিয়াম হোসেন মাহি (৯) ও মেয়ে তাসনিম (৬)। তবে হত্যাকারীরা ওই পরিবারের ৪ মাসের শিশু মারিয়া সুলতানাকে না মেরে জীবিত অবস্থায় দোলনার মধ্যে রেখে যায়। এ ঘটনায় কেউ আটক হয়নি, তবে থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
প্রতিবেশীরা জানান ভোরে তারা ওই বাড়ির চিৎকার চেচামেচি শুনে ছুটে যান। পরে দরজা খুলে দেখতে পান সাবিনা খাতুন ও তার দুই শিশু তাসমিন ও মাহী একঘরে এবং আরেক ঘরে শাহীনুরের জবাই করা লাশ পড়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে শাহীনুরের পা রশি দিয়ে বাাঁধা । তার পা ও হাতের রগ কাটা। একই পরিবারে থাকা শাহীনুরের ছোটভাই রায়হানুল ইসলাম জানান তিনি গোঙানির শব্দ শুনে ছুটে যান।
পরে সবাইকে খবর দেন। তিনি জানান হত্যাকারীরা ছাদে উঠে সিড়ির ঘর দিয়ে ঢুকে তাদের খুন করে দরজায় শিকল দিয়ে চলে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছায়। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত লাশগুলি ঘরেই ছিল। সেখানে পুলিশের ক্রাইম সেকশন ও সিআইডর ফরেনসিক বিভাগ কাজ করছে বলে সংবাদকর্মী ও অন্য কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
নিহত শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম বলেন, বাড়িতে মা ও বড় ভাইয়ের পরিবারের ৪ জন সহ তারা ৬ জন থাকতো। মা কাল কুটুম (আত্মীয়ের) বাড়িতে ছিলেন। তিনি (রায়হানুল) ছিলেন পাশের ঘরে। ভোরে পাশের ঘর থেকে তিনি বাচ্চাদের গোঙানির (ব্যথার আওয়াজ) শব্দ শুনতে পান। তাৎক্ষণিক এগিয়ে গিয়ে দেখেন ঘরের বাইরে থেকে দরজা আটকানো। দরজা খুলে দেখা যায় বিভৎস দৃশ্য। কিছুক্ষণের মধ্যে নিষ্পাপ বাচ্চাদের আওয়াজও চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যায়। তারাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
রায়হানুল আরও জানান, তাদের সাথে জমি জায়গা নিয়ে পাশের কিছু লোকের বিরোধ ছিল। কিন্তু কারা এ ঘটনা ঘটালো তা বুঝতে পারছি না।
কলারোয়া হেলাতলা ইউপি চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, তিনি এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, পরিবারটি ছিল অত্যন্ত নিরীহ। তারা কোন দল করতো না। কারো সাথে তাদের বিরোধও ছিল না।
ভাই রায়হানুল ইসলাম আরও জানান তার বড়ভাই শাহীনুর ইসলাম নিজস্ব ৭-৮ বিঘা জমিতে পাঙাস মাছ চাষ করতেন। গত ২২ বছর ধরে তাদের পারিবারিক জমি নিয়ে নিকট প্রতিবেশী ওয়াজেদ কারিগরের ছেলে আকবরের সাথে মামলা চলছিল। এই মামলা ও পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকান্ড ঘটে থাকতে পারে বলে তার ধারনা। পুলিশ রায়হানুলকে জিজ্ঞ্াসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে।
নিহত শাহীনুরের খালাতোভাই মো. হাসানুর রহমান জানান, তার ভাইয়ের সাথে কোন শত্রুতা ছিল না। কেবলমাত্র জমিজমা নিয়ে আকবরের সাথে ২২ বছর মামলা চলছিল। আমি এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের ফাসি চাই।
পরিবারের স্বজন ও প্রতিবেশিরা জানান কলারোয়ার দামোদরকাটী গ্রামের নূর আলীর ছেলে জনৈক আকবর হোসেনের কাছ থেকে ৩৪ শতক জমি ক্রয় করেন প্রতিবেশি ওয়াজেদ আলির ছেলে আকবর আলি। এর মধ্যে কিছু জমি নিয়ে আকবরের সাথে শাহিনুরের মামলা চলছিল। এই বিরোধ ছাড়া শাহিনুর পরিবারের রসাথে কারও কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। তাদের ধারনা জমির কারণেই তাকে সপরিবারে খুন হতে হয়েছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেছে জীবিত থাকা একমাত্র শিশুকন্যা মারিয়া সুলতানা (৪মাস)কে স্থানীয় ইউপি সদস্য নাসিমা খাতুন নিরাপত্তার জন্য নিয়ে যান। পরে তিনি তাকে আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করেন।
কলারোয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) হারান চন্দ্র পালের নির্দেশে থানার এসআই মফিজুল ইসলাম ঘটনাস্থলে যান।
ওসি হারান চন্দ্র হত্যাকান্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, নিজেদের ঘরের মধ্যে গৃহ প্রধান শাহিনুর রহমান সহ চারজনকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে শাহিনুরের পা বাধা ছিল এবং তাদের চিলে কোঠার দরজা খোলা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে ছাদের চিলে কোঠার দরজা দিয়ে হত্যাকারীরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছিলো। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ কাজ শুরু করেছে।
পরবর্তীতে কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারান চন্দ্র পাল জানান, পুলিশ সুপার মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মির্জা সাল্হাউদ্দিনসহ আমরা সকলেই ঘটনাস্থলে রয়েছি। হত্যার প্রাথমিক কোন কারনও জানা যায়নি। ঘটনাস্থলে সিআইডি, গোয়েন্দা পুলিশ, ডিএসবি, র্যাব এবং অন্যান্য গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত রয়েছেন। সাতক্ষীরা-যশোর সড়কের ধারেই অবস্থিত এই বাড়িতে এখন শত শত লোক ভিড় করছেন। ময়না তদন্তের জন্য লাশগুলি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই দুঃখজনক ঘটনার তদন্তে নেমেছি আমরা। হত্যাকরীদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, ঘাতক যেই হোক তারা রক্ষা পাবে না।
এদিকে ৪ মাস বয়সী শিশুটির দায়িত্ব গ্রহন করেছেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল। তিনি শিশু মারিয়া সুলতানাকে ইউপি সদস্য নাসিমা খাতুনের কাছে জিম্মায় রেখেছেন। এখন থেকে তার চিকিৎসা এবং জীবন গড়ার যাবতীয় দায়িত্ব জেলা প্রশাসক গ্রহন করেছেন বলে ঘটনাস্থলে যেয়ে তিনি ঘোষনা দেন।