আশাশুনি ব্যুরো: “দাই মা” (ধরনী) এক সময় ছিলেন গ্রাম-অঞ্চলের গর্ভবতী মহিলাদের ভরসার অন্যতম স্থান। কোন এক সময় গ্রামের কোন বউ গর্ভবতী হওয়ার সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী দাই মা’(ধরনী)দের কদর বেড়ে যেত। তখন দাই মা’রা যে বাড়িতে যেতেন আদর যতœ করে মুরগী জবাই করে খাওয়ানো হত। রাত বিরাতে দাই মা’দের ডাক পড়তো। আর দাই মা’রা ছুটে বেড়াতেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম পর্যন্ত। দাই মা’রা ছিলেন গ্রামে সবার কাছে সবচেয়ে পরিচিত মুখ। তাদের কদর ছিল খুব বেশি। কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রাম্য ধনিদের বাড়িতে দাই মা’দের তিন/চার দিন থাকতে হত। তাদের কে সবাই সম্মান করত। কাজ শেষ করে আসার সময় দাই মা’দের নতুন শাড়িসহ বিভিন্ন উপকৌঢন উপহার দিতেন। সে সময় যে মহিলার সন্তান হয়েছে সে মহিলার বাপের বাড়ি থেকেও সংশ্লিষ্ট দাই মা’দের জন্য আলাদা জিনিসপত্র দেওয়া হত। মমতা ভরা হৃদয় দিয়ে তাদের ডাকা হত দাই মা’ বা ধন্নী মা। কালের বিবর্তনে দাই মা’দের সেই কদর শেষ হয়ে গেছে। এখন দাই মা’দের সে কদর আর নেই। সব শ্রেণীর মানুষে সাথে তাদের পরিচয় তাকলেও প্রয়োজন নেই। প্রসুতি মেয়েরাও তাদের কে আর কাছে টানেন না। দাই মা’রা এখন খুব কষ্টে জীবন-যাপন করছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন আর এসব কাজ করেন না। তাদের জায়গায় এখন অবস্থান নিয়েছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান। যার ফলে এখন তারা গ্রামের গর্ভবর্তী মহিলাদের ভরসার এ স্থানে চিড় ধরেছে।
অথচ এক সময় আশাশুনির প্রায় সকল গ্রামেই দাই মা’দের বিচরণ ছিলো। দাই মা’ সকল গ্রামেই বাস করতেন। গর্ভবতী মেয়েদের চিকিৎসার জন্য তাদের ডাক পড়ার সাথে সাথেই তারা সে বাড়িতে ছুটে যেতেন। সফলভাবে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর পরিবারের অন্যদের মত তাদেরও আনন্দের সীমা থাকত না। তখন সেই পরিবারের গৃহকর্তা খুশি হয়ে দাই মা’দের অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র উপহার দিতেন। আর সেই প্রসবকৃত সন্তান বড় হওয়ার পর তাদের উপার্জনকৃত টাকা হতে মাঝে মাঝে সংশ্লিষ্ট দাই মা’দের কিছু দেওয়া হত। তারা মায়ের মত দাই মা’দেরকে শ্রদ্ধা করত। সে সময় গর্ভবর্তী মাকে সকল চিকিৎসাসেবা প্রদান করতেন দাই মা’রা। অতীতে এক দাই মা’ অন্য দাই মা’দের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। একে অপরকে তাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার কথা বলতেন। কিন্তুুুুুুুুুুুুুুুু এখন সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সব কিছু হারিয়ে গেছে। তারা আর একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখছেন না সবাই যার যার সংসার কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। দাই মা’দের মধ্যে অধিকাংশই অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে জীবন-যাপন করছেন। কখন কখন কোন দাই মা’র অন্য দাই মা’দের সাথে দেখা হলে তারা শুধুমাত্র তদের নিজ নিজ সংসার কর্ম নিয়ে আলোচনা করেন। আগের মত তাদের আর গ্রামের প্রসূতি মেয়েদের নিয়ে আলোচনা করতে হয় না। কারন গ্রাম-অঞ্চলে দাই মা’দের কদর ফুরিয়ে গেছে। এখন সবই কেবল স্মৃতি এবং অতীত। উপজেলায় বসবাসকারী একাধিক দাই মা বলেন, আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে আমরা আজ হারিয়ে গেছি। আমাদের কদর আর নেই। এক সময় আমরাই ছিলাম প্রসূতি মেয়েদের একমাত্র ভরসা। আমাদের কদর ছিল খুব বেশি। দাই মা’রা জানান, এখন আমরা বড় অভাবের মধ্যে দিন যাপন করছি। আমার হাতে এই এলাকার প্রায় শত শত সন্তান জন্ম কিন্তু সেই সন্তানরা এখন আর আমার সাথে কথা বলে না। আর তাদের বাবা মাও আমারে দেখলে অন্য দিকে তাকায়। আধুনিক যুগের ডাক্তারা আমাদের কদর কমিয়েছেন কিন্তুু আজ যারা বড় বড় ডাক্তার হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত আমাদের মত কোন না কোন দাইমা’র হাতে জন্ম নিয়েছেন। আর তারা ডাক্তার হয়ে আমাদেরকে ঘৃনা করে দূরে তাড়িয়ে দেন। আমার মতে ডাক্তার সাবদের উচিত দাই মা’দের ঘৃনা না করে, উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দাই মা’দের প্রসূতি কাজে আরো পারদর্শী করে তোলা।
“দাই মা” আজ যেন স্মৃতিতে
পূর্ববর্তী পোস্ট