শ্যামনগর বুরো: সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সুন্দরবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও বরাদ্ধকৃত টাকা আত্মসাৎ প্রচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদার ও তার লোকজনের উপস্থিতি ছাড়াই প্রধান শিক্ষক, সভাপতি, ঠিকাদার এবং রাঘব বোয়ালদের যোগসাজসে বরাদ্ধকৃত টাকার সিংহভাগ হরিলুটের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে অভিমত স্থানীয়দের। তাড়াহুড়া করে মেজে ঘষে শেষ করা হচ্ছে সংস্কার কাজ। প্রধান শিক্ষক বলছেন আমি শুধু কাজ দেখে নিচ্ছি আর সভাপতি বললেন কাজ ভাল হচ্ছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে নিম্ন মানের কাজের প্রতিচ্ছবি। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে সচেতন এলাকাবাসী।
জানা গেছে, শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনয়নের একটি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীট সুন্দরবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ৪০০ ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। এখানকার অবকাঠামোগত দৃশ্যপটও মোটামুটি ভাল। রয়েছে খেলার মাঠ, রয়েছে দ্বি-তল ভবন, রয়েছে ম্যানেজিং কমিটি, পাশাপাশি রয়েছে সরষের মধ্যে ভূতও।
জানা যায় সরকারিভাবে সংসদ সদস্যদের বাজেট থেকে দশ লক্ষ টাকা ঠিকাদারের মাধ্যমে বিদ্যালয় মেরামতের জন্য প্রদান করা হয়। সম্প্রতি এমনই একটি সংস্কার কাজের বাজেট হয় অত্র বিদ্যালয়ের জন্য। কাজের ঠিকাদার খুলনার টুটপাড়ার এক ব্যক্তি।
স্থানীয়দের অভিযোগ কাজের টেন্ডার পাওয়ার পর উক্ত ঠিকাদার মাত্র ১/২বার এখানে এসেছেন। নিয়মানুযায়ী তিনি কাজ না করে বিদ্যালয়ের সভাপতি, প্রধান শিক্ষক, কমিটির আরও কয়েক সদস্য সহ আরও কয়েক রাঘব বোয়ালের যোগসাজসে কাজটি যেনতেনভাবে শেষ করার চেষ্টা করছেন। এখানে ঠিকাদারের নিজস্ব কোন শ্রমিক নিয়োগ করা হয়নি। সভাপতির মাধ্যমে কয়েকজন শ্রমিক উক্ত সংস্কার কাজ কোন মতে মেজে ঘষে শেষ করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি সহ আরও কয়েকজন ঠিকাদারের যোগসাজসে ১০ লক্ষ টাকার মেরামতের কাজ দুই থেকে তিন লক্ষ টাকার মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করছে।
সংস্কার কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির দাতা সদস্য আবু দাউদ গাজী বলেন, বিদ্যালয়ের দ্বি-তল ভবনের সংস্কার কাজের জন্য ১০ লক্ষ টাকা বাজেট হয়। জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু কাজ শুরু হয় জুন মাসের ৫ তারিখে। ঠিকাদারের কোন লোকজন এখানে আসেনি। ঠিকাদার গত ২৮ জুন তারিখে একবার এসেছিলেন।
তিনি বলেন, কমিটির সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি, প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন, শিক্ষক শেখ আসলাম হোসেন, অভিভাবক সদস্য বকুল ফকির ও সগীর আহমেদ এই ৫ জনে মিলে সাব টেন্ডার নিয়ে সংস্কার কাজ করাচ্ছেন। আমাকে নামে মাত্র কাজ দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে বাকি সবকিছু দেখাশোনা করছে প্রধান শিক্ষক। যেভাবে কাজ মানসম্পন্ন করা দরকার ছিল সেভাবে কাজ না করে শুধু মেজে ঘষে হালকাভাবে ঠিক করে কাজ শেষ করছে, এটা মানসম্পন্ন কাজ হচ্ছে না বলে আমি মনে করি।
স্থানীয় আব্দুর রাজ্জাক ও আনিছ বলেন, ১০ লক্ষ টাকার কাজ দেয়া হয়েছে কিন্তু এক থেকে দেড় লক্ষ টাকার কাজ হয়েছে বাকী টাকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন ও সভাপতি রবিউল ইসলাম এবং ঠিকাদার কাজ না করে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে।
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, একই বাজেট হরিনগর বনশ্রী শিক্ষানিকেতন এ কাজের ইন্সট্রুমেন্ট দেখেছি। কিন্তু আমি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে সুন্দরবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে কাজের ইন্সট্রুমেন্ট জানতে এবং দেখতে চাইলে তিনি আমাকে তা না দেখিয়ে বলেন কাজের ইন্সট্রুমেন্ট ছাড়া বাজেট এসেছে, আস্তে আস্তে কাজ হচ্ছে দেখতে পাবেন। তিনি বলেন, আমার দেখা মতে দুই থেকে তিন লক্ষ টাকার মতো কাজ হয়েছে বাকি টাকাগুলো প্রধান শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও ঠিকাদার আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে। বিষয়টিতে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
ঘটনার অনুসন্ধানে একাধিকবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের শ্রেণিকক্ষে কিছু কিছু জায়গার প্লাস্টার ছাড়িয়ে খামচা-খামচা জায়গায় হালকা প্লাস্টার করা হয়েছে। যেখানে বালু সিমেন্টের পরিমানও সঠিক আছে কি না তা বোঝা যায়নি।
জানালার পুরাতন গ্রীলে নিম্ন মানের রং করা হচ্ছে। পুরাতন ভবনগুলোও কিছুটা রং করা হয়েছে। তাছাড়া স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল রাখার জন্য একটা ছোট ঘর তৈরি করা হচ্ছে।
গত ৩০ জুন সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় কয়েকজন ব্যক্তি উক্ত মাজা ঘষার কাজ করছেন। কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে একজনের সাথে কথা হলে তিনি তার নাম মোশারফ হোসেন বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, আমরা ৭ জন লোক এখানে সংস্কার কাজ করছি, আমি এই ৭ জনের প্রধান। তারা কার লোক এবং কিভাবে তারা কাজ করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের বাড়ী শ্যামনগরের গোপালপুরে। আমরা ঠিকাদারের কোন লোক নই। বিদ্যালয়ের সভাপতি আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন। তিনি আমাদের যেভাবে কাজ করতে বলেছেন আমরা সেভাবে কাজ করছি। গত ২০ দিন ধরে আমরা এখানে দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে কাজ করছি। ৩০ জুন তারিখে তিনি বলেন সম্পূর্ন বিল্ডিং এর সংস্কার কাজ শেষ, সাইকেল সেডের কাজ শেষ হলে পুরো কাজ শেষ হবে।
এ ব্যাপারে বিষয়টিতে সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সহ প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সচেতন এলাকাবাসী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েক ব্যক্তি বলেন, প্রধান শিক্ষক কমিটির সভাপতির বাড়ীতেই ভাড়া থাকেন। তাদের মাঝে যোগসাজস রয়েছে। তারা বলেন, কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও এ উপজেলার সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুই-একজন জনপ্রতিনিধিও এর সাথে জড়িত থাকতে পারেন। কারণ তাদের ছত্রছায়া না থাকলে এতাবড় পুকুর চুরি করা সম্ভব নয়। তারা বলেন দূর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে চুনোপুটিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঐ সব রাঘব বোয়ালদেরও খুঁজে বের করা যাবে। বিষয়টিতে সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সহ প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সচেতন এলাকাবাসী।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, কাজের বিষয়টি ঠিকাদার ও ইঞ্জিনিয়ার ভালো বলতে পারবেন। আমাকে কাজ দেখে নিতে বলেছে তাই কাজ দেখে নিচ্ছি, এখনো সাইকেল সেডের কাজ বাকী আছে। । কাজ শেষ হলে বুঝা যাবে ভালো কি খারাপ হচ্ছে।
তার কাছে কাজের সিডিউল ও গুণগত মানের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কিছুটা রেগে বলেন, সিডিউলের বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন কেন ? আমি যেটা বলছি সেটা আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে। এছাড়া তিনি ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের সভাপতি রবিউল ইসলাম (রবি) বলেন, কাজ সঠিক হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগের বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি বলেন, আবু দাউদ সহ কিছু লোক এমন অভিযোগ করে থাকতে পারে। তাদের অভিযোগ সঠিক নয় বলেও দাবী করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের কাছে কাজের ঠিকাদারের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর চাইলে তারা তা না দেয়ায় সংশ্লিষ্ট ঐ ঠিকাদারের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
কাজ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, ঠিকাদার করোনার কারনে খুলনায় থাকায় কমিটির মাধ্যমে মেরামতের কাজটি করতে বলেছেন, তাই কাজ করানো হচ্ছে । আমার জানামতে কাজ ভালো হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা ৪ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য এস এম জগলুল হায়দার বলেন, যদি কাজ নিয়ে দুর্নীতি হয় তাহলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না, সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।