১২ ডিসেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন। সম্মেলনকে সামনে রেখে সভাপতি পদে আলোচিত সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবির একান্ত স্বাক্ষাতকার। স্বাক্ষাতকারে তিনি স্কুল জীবন থেকে ছাত্র রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। স্বাক্ষাতকার গ্রহন করেছেন হাবিবুর রহমান।
সাতনদী : ছাত্র রাজনীতি থেকে যুদ্ধে যাওয়ার শুরুর গল্পটা কি।
মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি : পিএন হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করি। রাজনীতিতে প্রবেশে আমার গুরু ছিলেন কামরুল ইসলাম ভাই (জনকন্ঠের বার্তা সম্পাদক) ও বন্ধু হিসেবে অবদান ছিল কিসমতের। পিএন হাইস্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি ছিল। ওই কমিটির আমি সভাপতি ছিলাম। সে সময় সিনিয়র বড় ভাই হিসেবে নানামূখী উপদেশ দিতেন প্রয়াত এমএনএ এফএম এন্তাজ আলী, কাজী কামাল ছোট্টুসহ আরও অনেকে। সে সময়কার ছাত্র সংগঠণগুলোর মধ্যে ছিল ছাত্রলীগ, এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফোরাম) ও ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি ছিল। কামরুল ভাই ভাল সংগঠক ছিলেন। তিনি আমাদের নিয়ে প্রায়ই বসতেন। আলোচনা করতেন। দেশপ্রেম-অধিকার নিয়ে কথা বলতেন। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মনোবৃত্তি তৈরী করেছিলেন তিনি।
সাতনদী : মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুহূর্তগুলোর বর্ননা জানতে চাই।
মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার মনোবল তৈরী হয়। উচ্চ মাধ্যমিক ফাইনাল ইয়ারেই মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। পরীক্ষা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পর সাতক্ষীরা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আমি ওই কমিটির সদস্য ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গঠিত সংগ্রাম কমিটির ট্রেজারার ছিলেন এমএনএ আব্দুল গফুর। আমি প্রায়াত মুক্তিযোদ্ধা ইনামুল, আমিনুর রহমান (সাদা খসরু), হাবলুসহ অনেকে ভোমরাতে গিয়ে ক্যাম্প করি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া আমার শুরুটা ছিল এভাবেই। সেখানে শুরু হয় ট্রেনিং। আমরা শপথ নিলাম, মুক্তিযুদ্ধ করবো। দেশকে স্বাধীন করবো। তৎকালীন এসডিওর কাছ থেকে চাবি নিয়ে অস্ত্রাগার থেকে আমার পিতা মীর ইশরাক আলী ইসু মিয়া ও রাজা চাচা অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনলেন। রাজা চাচা নেভীতে চাকুরি করতেন। রাজ্জাক পার্কে রাজা চাচা আমাদের ট্রেনিং করায়। ট্রেনিং শেষে আমরা ভোমরায় চলে যাই। সে সময় এনএসএফ এর একটা অংশ মুক্তিযুদ্ধে সাপোর্ট করতেন। আমাদের সাথে রেগুলার ফোর্স ছিল না। আনসার, মুজাহিদ, ইপিআর, পুলিশ পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরা প্রথমে আর্মি আসেনি। তৎকালীন এসডিও খালিদ মাহমুদ এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আর্মির প্রয়োজন আছে কিনা ? তিনি বলেছিলেন, না। সাতক্ষীরার মানুষ শান্ত। পরে যখন ব্যাংক লুট হয় এসডিওকে আটক করলাম আমরা। এসডিওকে অনেকে চেয়েছিল মেরে দিতে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেটা চায়নি। পরে সাতক্ষীরায় আর্মি আসলো। আমরা ভোমরা ছেড়ে ভারতের বশিরহাটের ইউথ রিভিসশান ক্যাম্পে চলে গেলাম। সেখানে মেজর জলিল আসলেন। তিনি বল্লেন, তোমরা শুধু খাচ্ছ আর ঘুমাচ্ছো। এর আগে মেজর জলিলকে চিনতাম না। আমরা বল্লাম, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করতে এসেছি। তখন মেজর জলিল বল্লেন, আমি এসেছি তোমাদের তৈরী করতে। নবম সেক্টর চালাতেন মেজর জলিল।
সাতনদী : ট্রেনিং শেষে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনাগুলো কেমন ছিল।
ভারতের কোন ট্রেনিং ছিল কি ?
মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি : ট্রেনিং ছিলতো বটেই। ভাগিরতি নদীর (পলাশীর) তীরে ভারতের নেভীর তত্ত্বাবধায়নে আমি ট্রেনিং নিয়েছিলাম। আমদের ট্রেনিং শেষে ৮টি গ্রুপ করে মোংলা চিটাগং, চাঁদপুর, নারায়নগজ্ঞ, পাকসি ও সিলেটের ধামাইয়ে পাঠানো হয়। সিলেটের মৌলভীবাজারের ধামাইয়ে আমি ক্যাম্প কমান্ডার ছিলাম। আমি মংলায় যুদ্ধ করেছি।
সাতনদী : যুদ্ধ পরবর্তী কর্মকা- কি ছিল।
মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি : মুক্তিযুদ্ধ শেষে ছাত্রলীগ পুনঃগঠণ করে আমি তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হই। ছাত্রলীগকে সংগঠিত করে আমরা দেশ গঠনে ভূমিকা রাখি। যুদ্ধ শেষে ফিরে দেখি আমাদের দুটি বাড়ি মাটির সাথে মিশানো। যুদ্ধের সময় পরিবার ছিল ভারতে। ছোট ভাই লাকীকে এসডিপিও আটক করে নির্যাতন চালিয়েছিল। সেও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সাতনদী : শিক্ষা জীবন নিয়ে কিছু বলুন।
মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি : পিএন হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এরপর সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াকলীন সময়ে যুদ্ধে চলে যাই। যুদ্ধের পর ৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হই। ২ বছর অধ্যায়নের পর পড়াশুনা শেষ না করেই সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে চলে আসি। ভিপি নির্বাচিত হই। তৎকালীন সময়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শেখ জাহিদের কমিটির আমি সদস্য ছিলাম। পরে আওয়াল সভাপতি-জালাল সম্পাদক এই কমিটির আমি সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ছিলাম।
সাতনদী : বঙ্গবন্ধুর সহচর্য পেয়েছিলেন, সেই মুহূর্তের কিছুকথা জানতে চাই।
মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি : তিয়াত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আমাকে সাতক্ষীরার পাঁচটি আসনের প্রচার প্রচারণার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ওই সময়ে আমি কাজ করে নজর কাড়ি। যথাযথ দায়িত্বপালন করার কারণে তার নজরে পড়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে ৪-৫ বার আমার দেখা-সাক্ষাত হয়। দেখা হয়, ৩২ নম্বরে, তৎকালীন পার্লামেন্ট ভবনে ও গণভবনে। তিনি আমার মুখে চুমু দিয়েছিলেন। মনে পড়লে শরীরে আজও শিহরণ জাগে।
সাতনদী : ১৯৭৫ পরবর্তী আপনার রাজনীতির অবস্থান কি ছিল।
মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি : স্বপরিবারে বাঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেড় বছর যাবৎ পলাতক জীবন যাপন করেছি। এ সময় আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা লাকীকে এসডিও আটক করে অমানবিক টর্চার করে। ৭৮ সাল পর্যন্ত চাকরি বাকরি এবং ব্যবসার মধ্যে থাকি। পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম ঢাকাতে। তোফায়েল ভাই, আমু ভাই, রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান ও সিটি কমা-ার ছিলাম আমি এবং নৌ কমান্ডো অ্যাসোসিয়েশনের আমি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর প্রথম ৮৫ সালে তার মহাখালির বাসায় দেখা করি। দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়। শেখ হেলাল এমপির সাথে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসায় যায়। নেত্রী নির্দেশনামূলক পরামর্শ দেন। এরপর নেত্রীর সাথে যোগাযোগ রেখে ঢাকাসহ সাতক্ষীরার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখি।
সাতনদী : সংসার জীবন ও পরিবার নিয়ে কিছু বলুন।
মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি : ৭৮ সালে সংসার জীবনে পদার্পন অর্থাৎ বিয়ে করি। আমার স্ত্রী রওশন আরা বেগম গৃহিনী। ব্যক্তিগত জীবনে দুই পুত্র সন্তানের জনক। বড়পুত্র মীর তানজির আহম্মেদ পড়াশুনা শেষ করে ঢাকাতে হোটেল ব্যবসা করে। দ্বিতীয় পুত্র মীর ফাহমিদ আহম্মেদ। অষ্ট্রেলিয়া থেকে এমবিএ শেষ করে ওখানেই চাকুরি করে। বড় ছেলের স্ত্রী সাদিয়া সানজানা। একজন ফ্যাশান ডিজাইনার ও ইন্টেরিয়ার ডিজাইনার আর ছোট ছেলের স্ত্রী ফারহা শামস পেশায় প্রকৌশলী।