সিরাজুল ইসলাম,শ্যামনগর ব্যুরো: ‘বাঘের লাফ বিশ হাত, হরিণের লাফ একুশ হাত’। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় এই প্রবাদ বাক্যটি বহুল প্রচলিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাঘের থাবা থেকে রেহাই পেলেও শিকারির ফাঁদ ও গুলি থেকে রেহাই পাচ্ছে না পশ্চিম সুন্দরবনের চিত্রল হরিণ। সম্প্রতি পশ্চিম সুন্দরবনে হরিণ শিকারের এই চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পশ্চিম সুন্দরবনের আশপাশের এলাকাগুলোতে তাই নিয়মিতই বিক্রি হচ্ছে হরিণের মাংস। দিন দিন এই প্রবণতা বাড়ছেই। তবে বন বিভাগের দাবি, শিকারিদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত আছে। বেশ কয়েক বছর পশ্চিম সুন্দরবনে হরিণ শিকার সামান্যতম কমলেও বর্তমান গত কয়েক মাসে বেপরোয়া হয়ে উঠছে শিকারী চক্ররা। প্রতিনিয়ত খবর আসছে অবাধে হরিণ শিকারের। ২০১৮সালের শুরু থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত পশ্চিম সুন্দরবনের বন বিভাগ ও কোস্ট গার্ডের হাতে একাধিক হরিণ শিকারী চক্র আটক, হরিণের মাংস ও হরিণের ফাঁদ জব্দ করার ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবন থেকে ফিরে আসা গাবুরার কাঁকড়া আহরনকারী জব্বার, নাসির রেজাউল ও ডুমুরিয়া গ্রামের আলমগীর,আবু সাঈদ, মোকছেদ বলেন ভিন্ন কথা। তারা বলেছেন সুন্দরবনে হরিণ শিকারের সাথে বনবিভাগ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের নানা খাতওয়ারী ঘুষ বাণিজ্যের কারণে তারা দূর্বল থাকায় কিছু প্রভাবশালী শিকারী আছে তাদের শিকারে সময় বা ক্ষণ জানলেও বন বিভাগের ওই অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিজেদের অপরাধ ধাকতে এগুলো এড়িয়ে চলেন। তবে যখনই জনসাধারণ বা কোন বিশ্বস্ত সুত্র হরিণ শিকারের খবর বন বিভাগকে অবহিত করেন তখন তারা গা ঝাড়া দিয়ে শিকারীদের আটক বা গ্রেফতার করে বিভাগীয় বন মামলা দিতে বাধ্য হয়। স্থানীয় জেলে ও সচেতন মহল বলছেন, এক শ্রেণির ভোজনবিলাসী মানুষের কাছে হরিণের মাংসের ব্যাপক কদর রয়েছে। তাছাড়া, কেউ কেউ শৌখিনতার নামে হরিণের চামড়া ও শিং নিজেদের সংগ্রহে রাখতে, বিশেষ করে বাড়ির দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। এর জন্য তারা চড়ামূল্য দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না। ফলে শিকারিরাও অর্থের লোভে হরিণ শিকারে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোস্টগার্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, ‘হরিণের মাংস ও হরিণ শিকারের ফাঁদ জব্দ করা হলেও এর সঙ্গে জড়িতরা পালিয়ে যায়। তাদের ধরা যায় না। জব্দ করা হরিণের মাংস বন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ধ্বংস করা হয় বলেও জানান তিনি। বনসংলগ্ন এলাকার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হরিণের মাংস ব্যবসায়ীরা পেশাদার শিকারীদের অগ্রিম দাদন দিয়ে মাংস এনে নানা কৌশলে বিক্রি করছে। স্থানীয় কয়েকটি গ্রামে নিয়মিতই বসছে হরিণের মাংস বেচাকেনার গোপন হাট। এসব হাটে প্রতিকেজি হরিণের মাংস বিক্রি হচ্ছে ৪শ থেকে ৫শ টাকায়। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, চাঁদনীমুখা, পার্শ্বেমারী, ডুমুরিয়া, পদ্মাপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, দাতিনাখালী, পানখালী, মৌখালী, সিংহড়তলী, মরাগাং, টেংরাখালী, রমজাননগর, কৈখালী, কালিঞ্চীসহ সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে সুযোগ বুঝে শিকারিরা অনেক সময় প্রকাশ্যেই হরিণের মাংস বিক্রি করে থাকে। তাছাড়া এই সমস্ত নানা কৌশলে উপজেলা সদর, জেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে শিকারী চক্ররা হরিণের মাংস বিক্রির উদ্যেশ্যে পাচার করে থাকেন। একটি দায়িত্বশীল সুত্র জানিয়েছেন, উপজেলা এবং জেলার এক শ্রেণীর প্রভাবশালীরা এই মাংস ক্রয় করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখেন। সেখান থেকেও প্রভাবশালীরা তাদের আত্মীয়-স্বজন ও বিভিন্ন অপকর্ম জায়েজ করার জন্য সংশিষ্ট মহলকে এই মাংস দিয়ে সন্তোষ্ট করে। শ্যামনগর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রভাবশালী চেয়ারম্যান জানান,বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফাঁদ, বিষ, টোপ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেও হরিণ শিকার চলছে। কোনও কোনও সময় শিকারি চক্র জেলেদের ছদ্মবেশে বনের গহীনে গিয়ে হরিণ শিকার করে তা গোপনে লোকালয়ে নিয়ে আসে। পরে হরিণের মাংস, চামড়া, শিং কৌশলে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়।ওই ইউপি চেয়ারম্যান আরও জানান,সংঘবদ্ধ শিকারি চক্রের লোকালয়ে নির্দিষ্ট এজেন্ট নিয়োজিত রয়েছে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে ৪ থেকে ৫শত টাকা কেজি দরে হরিণের মাংস সংগ্রহ করা যায়। অনেক সময় টাকার পরিমাণ বেশি হলে এজেন্টরা সরাসরি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে হরিণের মাংস পৌঁছে দিয়ে আসে। পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল আলম মামুন বলেন, ‘আমরা হরিণের মাংস বিক্রি বা পাচারের খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। তিনি বলেন, ‘বনকর্মীদের কাজের গতি ও বন ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের জন্য সুন্দরবনকে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) আওতায় এনে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। এরই মধ্যে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিগগিরই সব রেঞ্জে এই ব্যবস্থা চালু হবে। এর ফলে বনকর্মীদের কাজের গতিবিধি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। শিকারি চক্রের গতিবিধি শনাক্ত করাও সহজ হবে।
সুন্দরবনে হরিণ শিকারীরা তৎপর, দেদারছে বিক্রি হচ্ছে মাংস
পূর্ববর্তী পোস্ট