সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর ব্যুরো: শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পঃপঃ কর্মকর্তা অজয় কুমার সাহার খুঁটির জোর কোথায় তা এখন সাধারণ মানুষের জানার বিষয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অজয় কুমার সাহার বিরুদ্ধে সীমাহীন ঘুস বানিজ্য ও অনিয়ম দূর্নিতীর খবর ৭ ও ৮ ই জানুয়ারী বিভিন্ন গণ মাধ্যমে খবর প্রকাশ পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোন গণ মাধ্যম কর্মীর চাকরী করি না। চাকরী করি সরকারের। জবাব দেব সরকারের কাছে। উল্লেখ্য, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অজয় কুমার সাহার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তার লাগামহীন দুর্নীতির কারনে উপজেলার একমাত্র সরকারি ৫০ শয্যা হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলেও অভিযোগ। এছাড়া রোগী ও স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহারসহ রোগীদের জন্য নিম্মমানের খাবার সরবরাহ, হাসপাতাল থেকে যথেষ্ট পরিমান ঔষধ সরবরাহ না করার অভিযোগ বেশ পুরানো। যদিও এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে উপজেলার শীর্ষ ঐ চিকিৎসা কর্মকর্তা। সরেজমিনে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে এবং সেবা প্রার্থী রোগী এবং তাদের স্বজনসহ স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে অজয় কুমার সাহা শিশু বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারনে সরকারি এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শিশু রোগীর স্বজনরা বহিঃবিভাগে টিকিট কেটে সন্তানদের দেখাতে নিয়ে গেলেও তিনি দেখতে অস্বীকৃতি জানান। তার দায়িত্ব প্রশাসনিক- এমন দাবি করে প্রয়োজন মনে করলে তিনি বেলা আড়াইটার পর নির্ধারিত ফিস নিয়ে তার চেম্বারে রোগী নিয়ে যেতে বলেন বলে অভিযোগ করেন মাজাট গ্রামের আমজাদ আলী। প্রায় অভিন্ন অভিযোগ এনে নিজের সাত দিন বয়সী শিশুকে ভর্তি থাকা অবস্থায় হাসপাতাল থেকে বের করে পাশের রিডা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান রোজিয়া বেগম নামের এক নারী ও তার ভাগ্নে। তাদের অভিযোগ অজয় সাহা শিশু বিশেষজ্ঞ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করার পর দুদিনে অনেক অনুরোধের পর একবারের জন্যও শিশুকে নিয়ে তার পরামর্শ নিতে ব্যর্থ হন তারা।
প্রায়ই এই ধরনের একটি ঘটনায় রতনপুর গ্রামের ওপেন হার্ট সার্জারী করা ১৩ মাস বয়সী এক শিশুর পিতামাতা তাদের একমাত্র সন্তানের চরম শাষকষ্টের মুহুর্তেও অজয় সাহার দারস্থ হয়ে দুর্ব্যবহারের শিকার হন বলে স্থানীয়রা জানান। ঐ ঘটনায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পর স্থানীয় সংবাদকর্মীদের নিয়ে তিনি মতবিনিময় করলেও অদ্যাবধি তিনি টিকিট করা কোন শিশুকে চিকিৎসা সেবা দেন না বলে স্থানীয় অনেকের অভিযোগ। এছাড়া রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহারেরও অভিযোগ উঠেছে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে সম্প্রতি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক ব্যক্তির সাথে দুর্বব্যহারের কারনে উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা প্রভাষক মোশারফ হোসেনের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের মধ্যস্থতায় বিষয়টি নিরসন হয় বলে স্বীকার করেন প্রভাষক মোশরফ হোসেন।
এদিকে সরেজমিনে মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালে পৌছে দেখা যায় রোগীদের জন্য ভাতের সাথে দুপুরের খাবার হিসেবে দুই পিছ ছোট বয়লার মুরগীর সাথে দুই পিছ আলু সর্বস্ব তরকারি। সকালে দুটি রুটির সাথে কলা- দিয়েছিল জানিয়ে পুরুষ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন দুই পুরুষ রোগীর দাবি। বাইরে থেকে আনিয়ে খাওয়ার মত সামর্থ্য না থাকায় যা পেয়েছে তা দিয়ে খেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
তবে স্থানীয় একাধিক সুত্র দাবি করেছে গোপনে নিজের পছন্দমত ঠিকাদারকে খাবার সরবরাহের কাজ দিয়ে অজয় সাহা নিজে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কারনে রোগীদের খাবার নিয়ে তিনি ‘টু’শব্দটি করেন না। রোগী এবং তাদের স্বজনরা বিগত কয়েক মাসে একাধিকবার খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললেও ‘ড্যাম কেয়ার’ স্বভাবের স্বাস্থ্য বিভাগীয় এ শীর্ষ কর্মকর্তা কোন অভিযোগ কানে তোলেন না। বরং রাধুনী ইতিমধ্যে একাধিকবার রান্নার বিভিন্ন উপকরন চুরি করে হাতেনাতে পাকড়াও হওয়া সত্ত্বেও অজয় সাহার বদৌলতে দিব্যি স্বপদে বহাল রয়েছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার রোগীদের জন্য নিম্মমানের খাবার সরবরাহ করছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
এদিকে বর্ষার মৌসুম অনেক আগেই শেষ হওয়ার পরও হাসপাতালের পুরুষ ও নারী ওয়ার্ডের দুইপাশে হাঁটু পর্যন্ত পানি জমাট বেঁধে দুর্গন্ধ ছড়ালেও হাসপাতালের প্রশাসনিক প্রধানের টনক নড়ছে না। বরং উপজেলা পরিষদ বা সদর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে পরিচ্ছন্নতা কর্মী পেলেই তিনি পানিসহ ময়লা আবর্জনা সরানোর উদ্যোগ নেয়ার প্রতিশ্রতিই বার বার দিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল রক্ষনাবেক্ষনের জন্য বরাদ্দের সমুদয় অর্থ তিনি নিজে আত্মসাৎ করে উপজেলা প্রশাসন বা সদর ইউনিয়ন পরিষদের পরিচ্ছন্নতা কর্মীর আশায় থাকার কারনে দিনে দিনে শ্যামনগর ৫০ শয্যা হাসপাতাল আবর্জনা আর ময়লার ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে। স্থানীয় অনেকে অভিযোগ করে জানিয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমিটির কোন সভা তিনি করেন না জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধির দিকে খেয়াল দিতে সময়মত স্বাস্থ্য কমিটির সভা আহবানের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু, অজ্ঞাত কোন কারনে তিনি দীর্ঘ ছয় মাসের মত কোন সভা আহবান না করে বরং নিজের একচ্ছত্র আধিপত্যে উপকুলবর্তী শ্যামনগরের প্রায় চার লাখ মানুষের জন্য নির্ধারিত একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিচালনা করায় স্বাস্থ্য সেবার মান ভেঙে পড়েছে বলে দাবি অনেকের। সরেজমিনে মঙ্গলবার হাসপাতাল পরিদর্শনকালে দেখা যায় যে প্রসুতী বিভাগের অপারেশন থিয়েটারের সামনে অসংখ্য মানুষের ভিড়। এসময় নুর হোসেন, আকবর আলী ও মারুফ হোসেনসহ অনেকে অভিযোগ করেন আগের দিন সোমবার দুই জন চিকিৎসক অপারেশন করলেও মঙ্গলবার একজন নারী চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। রোগীদের এসব স্বজনরা আরও অভিযোগ করে জানান, একজন মাত্র সেবিকা দিয়ে অপারেশন থিয়েটার চালাতে হচ্ছে। বাইরের এক প্রতিবন্ধী শিশুকে পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে অপারেশনের গুরুত্বপুর্ন উপকরনাদী আনা নেয়ার কাজে। অপারেশন থিয়েটারের মত গুরুত্বপুর্ন এবং স্পর্শকাতর স্থানে এভাবে বাইরের জামা জুতায় একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর অবাধ যাতায়াতে তাদের রোগীদের নিয়ে তারা নিজেরা শংকাও প্রকাশ করেন।অভিযোগ উঠেছে ইতিপুর্বে জনৈক আনিছুর রহমান প্রসুতীদের অপারেশন করতেন।সম্প্রতি নুতন করে চিকিৎসক নিয়োগের পর একজন নারী সার্জন এর আগমন ঘটলে অজয় সাহা নিজের বলয় বহাল রাখার তাগিদে দুই চিকিৎসকের মধ্যে কোন্দালের সৃষ্টি করে হাসপাতালেও রাজনীতি টেনে নিয়েছে। ফলে দুই চিকিৎসকের আত্মকোন্দলের কারনে ডাঃ আনিছুর রহমান মঙ্গলবার দিনভর নিজের ১০৪ নম্বর কক্ষে অবস্থান করা সত্ত্বেও অপারেশন থিয়েটারে না যাওয়ায় একমাত্র নারী সার্জনকে সকাল থেকে টানা তিনটা পর্যন্ত এক হাতে বেশ কয়েকটি অপারেশন করতে দেখা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শী স্বজনসহ হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়।
এসব ছাড়াও অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বাইরে থেকে ঔষধ আনিয়ে তাদেও চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ নিয়ে সরকারি বিভিন্ন ধরনের ঔষধ হাসপাতাল গেট সংলগ্ন দুই/তিনটি দোকানে বিক্রি করা হয় অজয় সার নির্দেশে। এসব অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা অজয় কুমার সাহা বলেন স্বল্প সময়ে দায়িত্ব নিয়ে চিকিৎসক সংকট দুর করতে সক্ষম হয়েছি। সত্তর দশকে নির্মিত হওয়ায় চারপাশের তুলনায় হাসপাতালের অবস্থান অপেক্ষাকৃত নিচু। যে কারনে একশ শয্যার নুতন ভবন নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার খুব বেশী উন্নয়ন ঘটানো যাচ্ছে না। তবে দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের জঞ্জাল দুর করতে সময় দিতে হয়। এ ব্যপারে ৮ নভেম্বর ২০১৯ এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে উপজেলা পঃ পঃ কর্মকর্তার নানা বিধ দূর্নীতি তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মহা পরিচালক বরাবর আবেদন করা হয়েছে।
শ্যামনগরে অজয় সাহার অনিয়ম ও দুর্নীতিতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেহাল অবস্থা!
পূর্ববর্তী পোস্ট