লাইলাতুলকদর এর অর্থ মহাসম্মমানিত ও মহিমান্বিত রাত।
আরবিতে লাইলাতুন শব্দের অর্থ রাত, আর কদর শব্দের অর্থ সম্মান বা মর্যাদা।
লাইলাতুলকদরের অন্য অর্থ হলো – তকদির বা ভাগ্য নির্ধারণ করা।এ পূণ্যময় রাতে মুসলিম মিল্লাত তথা উম্মাতি মুহাম্মদীর সম্মান, মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির তকদির পূনঃনির্ধারন করা হয়।তাই মুসলমানদের কাছে এ রাত অনেক বেশি সম্মানিত হিসাবে পরিচিত।পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ পাক এই রাতকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন।এবং এই একটি রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে বেশি সওয়াবের মর্যাদা রাখে।
প্রতি বছর রমজান মাসে এ রাত মহিমান্বিত রাত হিসাবে মুসলিমদের জীবনে সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে। তাই প্রত্যেক মুসলমান লাইলাতুলকদরের ইবাদত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
এ রাতে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করে আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজনীয় বিষয় চেয়ে নিতে বলা হয়েছে।
হযরত আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ” একদা আমি রাসুল সাঃ এর কাছে জানতে চাইলাম, হে আল্লাহর রাসুল আমি যদি কদরের রাত সম্পর্কে অবহিত হতে পারি তবে আমি কি করব? তখন রাসুল সাঃ আমাকে এই দুয়া পাঠ করার জন্য বললেন, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাআফু আন্নি”। ( তিরমিযি – হাদিস নং ৩৫১)
★লাইলাতুলকদরের ইতহাস:
১৬০ হিজরী সালে লাইলাতুলকদরের রাতে মক্কার নূর পর্বতের হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় মুহাম্মদ সাঃ এর নিকট সর্বপ্রথম কুরআন নাযিল হয়।
কেউ কেউ বলেন, মুহাম্মদ সাঃ এর নিকট সর্বপ্রথম সূরা আ’লাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়।
অনেকের মতে, এ পবিত্র রাতে ফেরেশতা জিবরাঈল আঃ এর নিকট সম্পূর্ণ কুরআন মাজিদ অবতীর্ণ হয়।যা পরবর্তীতে ২৩ বছর ধরে মহানবী সাঃ এর নিকট তাঁর বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট আয়াত আকারে অবতীর্ণ করা হয়।মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই রাত সম্পর্কে হাদিস শরীফে অনেক বর্ণনা এসেছে।এ ছাড়া পবিত্র কুরআনে সূরা কদর নামে স্বতন্ত্র একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ হয়েছে।
মুহাম্মদ সাঃ এর পূর্ববর্তী নবী এবং তাঁদের উম্মতগণ দীর্ঘায়ু লাভ করার কারনে বহু বছর আল্লাহর ইবাদত করার সুযোগ পেতেন।কিন্তু মুহাম্মদ সাঃ থেকে শুরু করে তাঁর পরবর্তী অনুসারীগণের আয়ু অনেক কম হওয়ায় তাদের পক্ষে আল্লাহর ইবাদত করে পূর্ববর্তী নবী ও তাঁদের উম্মতদের সমকক্ষ হওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিলনা। বিধায় তাদের মধ্যে আক্ষেপের সৃষ্টি হয়।তাদের এই আক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে এবং তাদের চিন্তা দুর করার জন্য আল্লাহ পাক সূরা কদর অবতীর্ণ করেন বলে হাদীসের বর্ণনায় পাওয়া যায়।
আল্লাহ পাক বলেন, ” সে রাতে প্রত্যেক প্রঙ্গাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় আমার নির্দেশে।নিশ্চয় আমি রাসুল প্রেরণকারী”( সূরা আদ দুখান, আয়াত- ৪,৫)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ” নিশ্চয় আমি এটি ( কুরআন) নাযিল করেছি বরকতময় রাতে। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।”(সূরা দুখান, আয়াত-৪,৫)
★লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা:
মুসলমানদের কাছে লাইলাতুলকদরের গুরুত্ব অপরিসীম এ জন্য যে, এ রাতে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে।
আল্লাহ এরশাদ করেন, “নিশ্চয় আমি তা( কুরআন) অবতীর্ণ করছি কদরের রাতে।আর কদরের রাত সম্পর্কে তুমি কী জান? কদরের রাত হলো হাজার মাস হতে উত্তম।সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ অবতীর্ণ হয়।প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।”( সূরা, কদর, আয়াত – ১-৫)
কদরের রাতের যাবতীয় কাজের ইঙ্গিত দিয়ে এ রজনীর অপার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা আদ দূখানের মধ্যে বলেন, ” নিশ্চয় আমি উহা ( কুরআন) এক বরকত রাতে নাযিল করেছি।নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।ঐ রাতে সমস্ত হিকমতপূর্ণ কাজের বর্ণনা করা হয় তথা বণ্টনের ফায়সালা করা হয়।” (সূরা দূখান, আয়াত- ৩,৪)
হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসুল সাঃ এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুলকদর পেল কিন্তু ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলোনা তার মতো হতাভাগা দুনিয়াতে আর নেই। ( মুসলিম- হাদিস নং-১১৬৭)
মহানবী সাঃ আরো বলেন, “যে ব্যক্তি এ রাতে ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করবে আল্লাহ তার পূর্বেকার সব গুনাহ মাফ করে দিবেন।”( বুখারী)
★★লাইলাতুলকদর মর্যাদাপূর্ন এক রাত।যেমন:
এক. কুরআন নাযিলের রাত:
বিশ্ব মানবের মুক্তির সনদ পবিত্র কুরআন এ মহিমান্বিত রাতেই অবতীর্ণ হয়।আল্লাহ পাক বলেন,” আমি একে ( কুরআন) কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি।” ( সূরা কদর)
দুই. হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম:
লাইলাতুলকদরের রাতের মর্যাদা অন্য সময়ের হাজার মাসের মর্যাদার থেকেও বেশি।তাই এ রাতের গুরুত্ব স্বাভাবিক ভাবেই বেশি।
তিন. ফেরেশতাগণের আগমন ঘটে:
এ পবিত্র রাতে ফেরেশতাগণ বেশি বেশি পৃথিবীতে আগমন করেন।তাঁরা সারা বছরের নির্ধারিত বিষয়গুলো নিয়ে আসেন।
ইত্যাদি কারনে এ রাতের মর্যাদা অন্য যে কোনো রাত হতে অনেক বেশি।
★কোন রাত লাইলাতুলকদরের রাত:
লাইলাতুলকদর কোন রাতে, এ নিয়ে অনেক মতামত রয়েছে।
হযরত উবাদাহ বিন সামিত রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাঃ একবার লাইলাতুলকদর সম্পর্কে সংবাদ দেয়ার জন্য বের হলেন।তখন দুই জন মুসলমানের মধ্যে ঝগড়া চলছিল( তাদের ঝগড়া মিটিয়ে) রাসুল সাঃ বলেন, ” আমি তোমাদেরকে লাইলাতুলকদরের সংবাদ দেওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি ঝগড়া করছিল ফলে এর ( লাইলাতুলকদরের) নির্দিষ্ট তারিখের আকল আমার থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।আশা করি এতেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।অতএব তোমরা এ রাতকে সপ্তম, নবম, ও পঞ্চম রাতে অনুসন্ধান করো।”
★লাইলাতুলকদরের তারিখ সম্পর্কে প্রায় চল্লিশটির বেশি মত রয়েছে। তবে অধিক যুক্তিযুক্ত মত হলো-
লাইলাতুলকদর রমাযানের শেষ দশকে হয়ে থাকে।
তবে রমযান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাত সমূহে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
হাদিস শরিফে রাসুল সাঃ বলেন,”রমাযানের শেষ দশকে তোমরা লাইলাতুলকদর অনুসন্ধান করো।”
অপর এক হাদিসে রাসুল সাঃ বলেন,”রমযানুল মুবারক মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাত সমূহে তোমরা লাইলাতুলকদর তালাশ করো।”(বুখারী)
মহানবী সাঃ লাইলাতুলকদর পাওয়ার জন্য রমাযানের প্রথম দশদিন ই’তিকাফে বসেন।অতঃপর দ্বিতীয় দশদিন ই’তিকাফে বসেন।
অতঃপর আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে প্রিয় নবীকে জানিয়ে দেন যে,এ রাত রমাযানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে রয়েছে। আর তা হলো ২১,২৩,২৫,২৭ ও ২৯তম রাত।
★তবে অনেক আলেম ২৭তারিখকে লাইলাতুলকদেরর অধিক সম্ভাবনা বলে মনে করেন।
# তাদের যুক্তি ঃ
লাইলাতুলকদর শব্দটির মধ্যে ৯টি অক্ষর আছে।আবার লাইলাতুলকদর শব্দটি অত্র সূরায় তিনবার উল্লেখ হয়েছে। ফলে মোট অক্ষরের সংখ্যা হয় ( নয় গুণ তিন) ২৭টি।এজন্যই ইহা ২৭রমযান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তবে হাদিস অনুযায়ী ২০রমাযানের পর যে কোনো বিজোড় রাতে কদর হতে পারে।
★পূণ্যময় এ রাতের কিছু আলামত ঃ
১.এ রাতের পূর্ববর্তী ভোরে সূর্য কিরণহীন অর্থাৎ সূর্যের তাপ নরম থাকে।
২.এ রাতে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজকরে।
৩.এ রাত স্পষ্ট আলোকোজ্জ্বল হয়।যা অন্য রাতসমূহে দেখা যায়না।
৪.পবিত্র এ রাতের শেষ ভাগে হালকা বৃষ্টিপাত হয়।
৫.এ রাতে মুমিন বান্দাগণ কুরআন তিলাওয়াতে খুবই আনন্দ পায়।
৬.এ রাতে আল্লাহপাক বান্দার দোয়া সমূহ কবুল করেন।
সুুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের এ পূণ্যময় রাতে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত ও নফল সালাত আদায়ের মাধ্যমে মহান আল্লাহর দরবারে লুটিয়ে পড়া উচিত।
লেখক: সহঃঅধ্যাপক, হাজী কেয়ামউদ্দীন মেমোঃ মহিলা কলেজ।