প্রধান প্রতিবেদক : ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচনী পরিবেশ অনুকূলে রাখা ও জিতেয়ে দিবেন বলে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. শহিদুল ইসলাম পিন্টুর কাছ থেকে নগদে তিন লাখ টাকা ঘুষ নেন আশাশুনি থানার তৎকালীন ওসি বিপ্লব কুমার নাথ। এছাড়াও আশাশুনি থানা পুলিশের পেছনে ওসির কথামত খরচ করেন আরও দুই লাখ। তবে ওসি নির্বাচনী পরিবেশ অনুকূলে রাখার শর্তে এ টাকা নেন ও কাজ করতে না পারলে ফেরৎ দিবেন বলে এই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদককে আশ্বস্ত করেন।
তবে এখন আর টাকা ফেরৎ দিচ্ছে না এই ওসি। মোবাইল কলটিও রিসিভ করছেন না তিনি। মাঝে মধ্যে তার স্ত্রীকে দিয়ে মোবাইলে কল রিসিভ করাচ্ছেন ওসি। অপর প্রান্ত থেকে স্ত্রী জানাচ্ছেন, তিনি ঘুমিয়েছেন। পরে কথা বলবে। এভাবেই তালবাহানা অব্যাহত রেখেছেন ওসি বিপ্লব কুমার নাথ।
এসব কথা জানিয়ে আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক অ্যাড. শহিদুল ইসলাম পিন্টু সাতনদীকে বলেন, গত ২৪ মার্চ উপজেলা নির্বাচনের চারদিন আগে রাত ৯টার দিকে আশাশুনি বাইপাস সড়কে দাঁড়িয়ে নগদ তিন লাখ নেন ওসি বিপ্লব কুমার নাথ। থানা পুলিশের গাড়ি নিয়ে তিনি ঘটনাস্থলে আসেন। আমাকে আশ্বস্ত করেন নির্বাচনী পরিবেশ অনূকূলে থাকবে, নির্বাচনে আপনি জিতবেন। সেময় থানা পুলিশের স্টাফরা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে মূহূর্তের মধ্যে উপজেলা নির্বাচনে অপর প্রার্থীর কাছ থেকে বিগ এমাউন্টের টাকা নিয়ে পাল্টি দেন ওসি বিপ্লব। আমার নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে দারোগা-পুলিশ পাঠাতে শুরু করে। ওসি নিজে মোবাইলে কল দিয়ে ও পুলিশ পাঠিয়ে নেতাকর্মীদের হুমকি অব্যাহত রাখে। নেতাকর্মীদের বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে নাইলে গ্রেফতার করে ডজনখানেক মামলা করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়।
আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ আরও বলেন, শ্রীউলা এলাকার লাকি। উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বুধহাটা এলাকার প্রফেসর ডাবলু, কুল্ল্যা এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন, শোভনালী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম গাইনসহ সকল ইউনিয়নের আমার নেতাকর্মীদের বাড়ি ছেড়ে দিতে চাপ সৃষ্টি করে ওসি। তখন ওসির সঙ্গে আমি কথা বল্লেও কোন ফল হয়নি। হুমকি অব্যাহত রাখেন তিনি।
ভোট গ্রহনের দিনে ওসির কর্মকা- বর্ননা করে তিনি জানান, ভোটের সময় উপজেলার ৮৫টি কেন্দ্রে থাকা পুলিশকে খামের মধ্যে করে সিসির সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা করে প্রদান করেন নিজ হাতে। দায়িত্বরত পুলিশ ফোর্সদের তিনি বলেন, নৌকার পক্ষে কাজ করতে। আমি নিজেই এ টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বিপ্লব কুমার নাথ বলেন, পুলিশ সুপার এ টাকা দিয়েছে। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ নৌকাকে জেতানোর কথা বলেছেন। আমার কিছুই করার নেই। এরপর আমার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিতে শুরু করে ওসি। ৫০-৫২টি কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্টদের বের করে দেয় ওসি।
এসব ঘটনার পর আমার দেওয়া তিন লাখ টাকা ফেরত চাইলে তিনি শুরু করেছে তালবাহানা। আমি আমার টাকা ফেরত চাই। টাকা না দিলে আমি আইজিপির কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করবো বলেন জানান আওয়ামী লীগের এই নেতা।
তবে তৎকালীন আশাশুনি ওসি বিপ্লব কুমার নাথের বিরুদ্ধে থানায় ধরে নিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা নেওয়া, সীমানা প্রাচীর তুলে দেওয়ার জন্য টাকা নেওয়া, আদালত থেকে জামিনে আসা সহিংসতা মামলার আসামীদের গ্রেফতার ও নতুন মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা উত্তোলনের ঘটনা কম নয়। দাপটের সঙ্গে তিনি এসব করেছেন আশাশুনি থানায়। আশাশুনি থানাকে তিনি বলতেন, ভারতের বশিরহাট থানা। আর টাকাকে ডাকতেন মন্টু বলে। আস্ফালন করে ওসি বিপ্লব কুমার নাথ বলতেন, মন্টু ছাড়া আমি কোন কাজ করি না। এসব ঘটনাগুলো সাতনদীকে জানান কয়েকজন ইউপি সদস্য। তার মধ্যে এক ইউপি সদস্য নিজের হাতেই ৩৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন ওসি বিপ্লবকে। সেই ইউপি সদস্য জানান, আশাশুনি উপজেলার নৈকাটী এলাকায় পলাশের তৈরী করা প্রাচীর ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য আহসানউল্লাহ’র পক্ষে ওসি ঘুষ নেয় ৩৫ হাজার টাকা। টাকা নিয়ে প্রাচীর ভেঙ্গে দেয় ওসি।
ইউপি সদস্যরা জানান, নির্বাচনের আগে ওসি নিজেই ঘোষনা দিয়ে বলতেন, আমার সঙ্গে দেখা না করে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে কেন এরা। মাদক, সুদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোয়ারা আদায় করতেন ওসি সাহেব। এসব আদায় করতেন দারোগা ইসমাইলের মাধ্যমে। মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়েছেন প্রতিনিয়তই। সে বদলী হওয়ার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছে আশাশুনির মানুষ।
আশাশুনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহন করা এক প্রার্থী জানান, তিনজন ইউপি চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রার্থী এবিএম মোস্তাকিমের পক্ষে কাজ করার জন্য ওসি বিপ্লবকে ১৮ লাখ টাকা দেয়। এরপর ওসি আরও ৮ লাখ টাকা দেয় নির্বাচনে মোস্তাকিমের পক্ষে কাজ করার জন্য। আশাশুনি ও কলারোয়া থানা থেকে পাঁচ কোটি টাকারও বেশী কামিয়েছেন ওসি বিপ্লব।
কলারোয়ার ওসি হিসেবে দায়িত্বপালনকালীন সময়ে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট নিয়ে কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, তিনি টাকা নিতেন তবে প্রকাশ্যে নিতেন না আর সকলের মন রক্ষা করে চলতেন।
জানা গেছে, আশাশুনির শ্রীউলা ইউনিয়নের লাকিসহ স্থানীয়রা ওসি বিপ্লবের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ঘুষ গ্রহন, অনিয়ম দূর্ণীতির অভিযোগ এনে খুলনা ডিআইজি বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন। ডিআইজি অফিসের এসপি আবু হেনা সরেজমিনে অভিযোগের তদন্ত করেন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মেলে। পরে ডিআইজির দপ্তর থেকে তাকে খুলনা বিভাগ ব্যতীত অন্য কোথাও বদলীর জন্য সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করারও সুপারিশ করা হয় যা এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ওসি বিপ্লবকে পুলিশ হেড কোয়াটার থেকে শাস্তিমূলক বদলী করা হয় আশাশুনি থেকে। এর আগে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহে ওসি হিসেবে দায়িত্বপালনকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম দূর্ণীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে ওসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে ঝাড়– মিছিল করেন স্থানীয়রা। পরে তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
অফিসার ইনচার্জ হিসেবে ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই সাতক্ষীরার আশাশুনি থানায় যোগদান করেন বিপ্লব কুমার নাথ। আশাশুনি থানা থেকে শাস্তিমূলক বদলী হন বদলী হন ২৫ মে ২০১৯ তারিখে। এর আগে তিনি সাতক্ষীরার কলারোয়া থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন জানিয়ে আশাশুনির তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিপ্লব কুমার নাথ সাতনদীকে বলেন, আমি বর্তমানে ঢাকাতে রয়েছি। আশাশুনি থেকে এসেছি তিন মাস হলো। এতদিন কেউ আমার বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ করেনি, এখন করছে। এটা পরিকল্পিত। কেউ হয়তো বা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে সাহস যোগাচ্ছে সেকারণে তিনি এসব বলছেন। তবে তা আদৌই সত্য নয়। আমি তার কাছ থেকে নির্বাচনকে ঘিরে কোন টাকা নেয়নি। টাকা নিলে চলে আসার আগেই বলতো। এখন বলছে কেন ?
তিনি আরও বলেন, এছাড়া খুলনা ডিআইজির কাছে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ হয়েছে আমার জানা নেই। অভিযোগ হলে তো আমি জানতাম। যে অভিযোগ গুলো আমার বিরুদ্ধে আনা হচ্ছে তা পরিকল্পিত।