আমরা যারা ইছামতি নদীর পাড়ে যাই আমাদের ভিতরে একটা প্রশ্ন কাজ করে নদীর পাড় ভাঙ্গা অট্টালিকা….. আজ বলব টাকির পুবের বাড়ীর কথা। মূল জমিদারবাড়ীগুলোর পশ্চিম দিকে অবস্থিত হয়েও এই বাড়ীটি কেন পুবের বাড়ী নামে খ্যাত, নিশ্চই প্রশ্ন জাগে ? ফিরে যাই একটু আগের কথায় অষ্টাদশ শতকের শেষে টাকির রায় চৌধুরী পরিবারের চার শরিক তাদের পৈতৃক ভিটার চারদিকে চারটি পৃথক পৃথক বাড়ী তৈরী করেছিলেন, দিক অনুসারে বাড়ীগুলোর নাম হয় পুবের বাড়ী, পশ্চিমের বাড়ী, উত্তরের বাড়ী ও দক্ষিণের বাড়ী। সম্পূর্ণ এলাকা ছিল ইছামতী নদীর পার্শ^স্থ অঞ্চলেই, নদী ছিল তখন বেশ সরু, কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে ইছামতীর পশ্চিম পাড় ভাঙে এবং পূর্বপাড় গড়ে। সেজন্য এখনও টাকির দিকটা ক্রমশ ভাঙছে এবং বাংলাদেশের দিকটায় চর পড়ছে। যাইহোক, তৈরী হওয়ার পর থেকেই আলোচ্য পুবের বাড়ীর অবস্থান ছিল একেবারে পূর্বে, নদী সংলগ্ন অঞ্চলে সেজন্য এই বাড়ীটি ইছামতীর ভাঙনে সবার আগে ভেঙে পড়ে। তখন জমিদার ছিলেন সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী, তারই উদ্যোগে পশ্চিমদিকে তাদের চাকরান জমির একটা অংশে বর্তমান হাসপাতালের উল্টোদিকে গড়ে ওঠে বর্তমান বাড়ীটি। সেই থেকে এই বাড়ীটাই পুবের বাড়ী নামে খ্যাত।
পুবের বাড়ীর মূল জমিদার কমলাকান্ত রায়চৌধুরী কাশীর রাজার দেওয়ান ছিলেন। তিনি দেওয়ানী মারফত প্রচুর টাকা পয়সা উপার্জন করে তা দিয়ে স্বদেশে জমিদারী কিনলেন যার বেশীর ভাগ ছিল চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, যশোহর-খুলনা প্রভৃতি জেলায়। তার সু্যােগ্য পুত্র সূর্যকান্ত রায়চৌধুরী ছিলেন এই বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি টাকিতে বহু জনহিতকর কাজের সাথে যুক্ত। টাকিতে আজ যে হাসপাতাল, এরিয়ান ক্লাব, পৌরসভা সবই পুবের বাড়ীর জমির ওপর নির্মিত। সোদপুরে এখনও যে ভগ্নপ্রায় নলকূপের অট্টালিকা দেখতে পাওয়া যায় তা সূর্যকান্ত সাধারণ মানুষের পানীয় জলের সুবিদার্থে নির্মাণ করেছিলেন। শুধু টাকি নয়, বসিরহাট টাউনহল ও তৎসংলগ্ন পার্কটি ও তার তৈরী । পানীয় জলের সংকট মেটাতে সূর্যকান্তের উদ্যোগেই খনন করা হয় বর্তমান রবীন্দ্রভবন সংলগ্ন পুকুরটি। পার্কটি আজও সূর্যকান্ত পার্ক নামে প্রসিদ্ধ। বসিরহাট বাজারটিও সূর্যকান্তের উদ্যোগে নির্মিত।
অন্যান্য জমিদারদের মতো পুবের বাড়ীর জমিদাররাও ছিলেন ধনংবহঃবব ষধহফষড়ৎফং. দক্ষিণ বাড়ীর মুন্সী বংশের সাথে বিবাদবসত তারা কোলকাতায় বাস করতে শুরু করেন। কিন্তু দূরে গিয়েও ভোলেননি টাকিকে। ২৯৯ আপার সার্কুলার রোডের বাড়ীটার নাম সূর্যকান্ত রাখলেন ‘টাকি হাউস’, অনেকে পরে তা স্থানান্তরিত হয়েছে টালিগঞ্জে।সূর্যকান্ত যথেষ্ঠ প্রজাবৎসলও ছিলেন। টাকিতেই তাদের চাকরান জমিতে বসবাসের সু্যােগ করে দেন ঋষিদাস(সৈন্যের বাগান সংলগ্ন অঞ্চলে) ও কাহারদের (এরিয়ান ক্লাব পার্শ^স্থ অঞ্চলে)।দেশভাগের ফলে পুবের বাড়ীর জমিদারীর একটা বড় অংশ চলে যায় বর্তমান বাংলাদেশে। সূর্যকান্তের পুত্র জগবন্ধু রায়চৌধুরীর আমলে জমিদারী প্রথার অবসান ঘটে ফলে এই বাড়ীর বাকি সমস্ত সম্পত্তিই সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। তা সত্বেও মূল জমিদারবাড়ীটি এখনও টিঁকে আছে। জগবন্ধুর স্ত্রী নমিতা রায়চৌধুরীর উদ্যোগে বাড়ীটা দেবোত্তর সম্পত্তিতে পরিণত হয়, যেকারণে প্রতিবছর নিয়মমেনে এবং বাধ্যতামূলকভাবে সাবেকি প্রথায় দুর্গাপূজা করা হয় এবং সেকারণেই জমিদারবাড়ীটাকে এখনও অক্ষুন্ন অবস্থায় দেখা যায়। টাকির জমিদারবাড়ী গুলো এখন আর নেই বললেই চলে। উত্তরের বাড়ী বহুদিন আগেই নিপেন্দ্র অতিথিশালায় পরিণত হয়েছে। পশ্চিমের বাড়ী একেবারে নিশ্চিন্ন। দক্ষিণের বাড়ী, যা রাজবাড়ী নামে খ্যাত ছিল, তার ধূলিসাৎ করে ফেলার কাজও সবেমাত্র শেষ হয়েছে। তাই টাকির প্রাচীন গৌরব- ঐতিহ্যবাহী রায়চৌধুরী জমিদারবাড়ীর অন্তিম অবলম্বন এখন এই পুবের বাড়ীই ।
ইছামতি নদীর পাড় ভাঙ্গা অট্টালিকা–লিটন ঘোষ বাপি


পূর্ববর্তী পোস্ট