নিজস্ব প্রতিবেদক: বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে গড়ে তোলা তার অন্ধকার সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট সাতক্ষীরা শহরের টক অব দ্যা টাউন গোল্ডেন মনির। কুখ্যাত এ চোরাকারবারি ও বিএনপি নেতাকে ধরার জন্য রেড এলার্ট জারি ও পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ।
সম্প্রতি একটি ডাকাতির মামলাকে কেন্দ্র করে আবারও আলোচনায় এই গোল্ডেন মনির। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও সদরের দক্ষিণ কাটিয়া গ্রামের শেখ মোশারফ হোসেনের পুত্র ও পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি মাছুম বিল্লাহ শাহীনের ছোট ভাই মনির। মাদক, গার্মেন্টস ও গোল্ড এর চোরাকারবারী মনি টাকার জোরে সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে আসছিলো। কালো টাকা সাদা করতে শহরে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হাঁকিয়েছে। সাতক্ষীরা শহরে কাটিয়া, নারকেলতলা, দাসপাড়া, ঋ-শিল্পি সহ শহরের বিভিন্ন এলাকা এবং ঢাকা শহরে বিপুল পরিমান সম্পত্তির মালিকানা আছে শীর্ষ এ চোরাকারবারির। যেগুলো চোরাচালান মাদক ব্যবসা সহ অবৈধভাবেই বানিয়েছে। শুধু সাতক্ষীরাতেই পৌরসভাধীন নারকেলতলার মোড়ে সাজিদ মটরস, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে সংগ্রাম মটরস, কালিগঞ্জের নলতায় বাজাজ মটরস এর শোরুম, বিনেরপোতা এলাকায় নির্মিত ১টি বিলাশ বহুল বাড়ী সহ নামে, বে-নামে লেটেস্ট মডেলের প্রাইভেট কার ও মালবাহী ট্রাকের মালিকানা রয়েছে তার। বিএনপি পরিবারে বেড়ে উঠা মনির সাথে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও জয়ের সাথে সখ্যতার অভিযোগও আছে। আন্ডারওয়ার্ল্ড ঠিক রাখতে প্রশাসনের কর্তা-ব্যাক্তিদের নানাভাবে ব্যবহার করে আলোচিত ও সমালোচিত এ চোরাকারবারি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত একদশকেরও বেশি সময় ধরে শহরের কাটিয়ার শেখ শফিউল্লাহ মনি ওরফে মোঃ মনি ওরফে শেখ মনিরুজ্জামান ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চোরাইপণ্য এপার-ওপার করে আসছে। ওপার থেকে দেশে বড় বড় ফেন্সডিলের চালান আসতো। ট্রাকের মাধ্যমে সেটা সরবারাহ করতো দেশের অভ্যন্তরে। পাশাপাশি ওপার থেকে গত একদশক ধরে গার্মেন্ট পণ্য শাড়ী ও থ্রি-পিচের বড় বড় চালান নিয়ে আসে সে। গত একদশকধরে তার এ কারবার ওপেন সিক্রেট। একাধিকবার বিজিবি তার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান ও গোডাউনে অভিযান চালিয়ে চোরাইপণ্য উদ্ধার করছে। মামলাও হয়েছে সেসব ঘটনায়। সে ফেন্সিডিল ও গার্মেন্টস পণ্যের পাশাপাশি শুরু করে বাংলাদেশ থেকে ওপারে গোল্ড ও এসির গ্যাস সিলিন্ডার পাঠানো। বিপুল অর্থ ও বৈভবের মালিক মনির আন্ডারওয়ার্ল্ড টিকিয়ে রাখতে কাড়ি কাড়ি টাকাও ঢালতো। গত ২০১৫ সালে ভারতে পাচারের সময় দুইট্রাক এসির গ্যাস সিলিন্ডার আটক করে ডিবি পুলিশ।
মনি এখন দেশের অন্যতম শীর্ষ গোল্ডস্মাগলার। গত একদশক ধরে সে এ কারবার করে আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকতা ম্যানেজ করে এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার চেষ্টা করলেও মাঝে মাঝেই ধরা খেয়েছে। অন্য দিকে সরকার বিরোধী নানা চক্রান্তেও জড়িত থাকার অভিযোগ আছে মনির বিরুদ্ধে। তার স্মার্গলিংয়ে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় বর্তমান পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান।
শেখ শফিউল্লাহ মনি বা গোল্ডেন মনিরের নামে এ পর্যন্ত ১১টি মামলা হয়েছে। সাতক্ষীরা সদর থানায় ২০০৬ সালের ৬ অক্টোবর মনির নামে একটি চাঁদাবাজির মামলা হয়। মামলা নং জি আর ৫৫২/০৮।
২০১২ সালের ১৭ জুলাই গোল্ডস্মার্গলিং করতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে গোল্ডস্মার্গলিং এর মামলা হয় মাদারীপুর জেলার শিবচর থানায়। মামলা নং ১৭। একই বছরের ৮ আগস্ট সাতক্ষীরা সদর থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২৭নং মামলা হয়।
সাতক্ষীরা সদর থানায় ২০১৮ সালে ২৭শে জানুয়ারী ৫৮ নং মামলা হয়। দুই দিন পর একই থানায় আরও একটি মামলা দায়ের হয় যার নম্বর ৭০।
২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৬৪/৯৬০নং আরও একটি মামলা হয় সাতক্ষীরা সদর থানায়। বছর না ঘুরতেই ২০২১ সালের ২৮ জুলাই সাতক্ষীরা সদর থানায় ৬৮/৫১৯ (জিআর৫১৯/২১) মামলা দায়ের হয়। এর দুইমাস পর ২৭ আগস্ট একই থানায় আরও একটি মামলা হয় যার এফআইআর নম্বর ৮০/৬০৬(জিআর ৬০৬/২০২১)
এদিকে ২০২৩ সালে ৬মার্চ কলারোয়ায় ডাকাতির প্রাক্কালে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় মনির। এ ঘটনায় কলারোয়া থানায় একটি ডাকাতির মামলা ও অস্ত্র মামলাও দায়ের হয় তার বিরুদ্ধে। যার নম্বর ১২ ও ১৩। সর্বশেষ একই থানায় গত ৫ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের হয়।
সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান যোগদানের পর মাদকবিরোধী এক অভিযানে গত বছরের ২৬ নভেম্বর ফেনসিডিল সহ গ্রেপ্তার হয় গোল্ডেন মনি সিন্ডিকেটের হোতা আল ফেরদৌস আলফা। আলফার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব বেড়ে যায় সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য শফিউল্লাহ মনির। তবে তিন মাস সিন্ডিকেটের দায়িত্ব পালনের পর নতুন করে পুলিশের সামনে আসে গোল্ড মনি। গত ৬ মার্চ রাত সাড়ে দশটার দিকে কলারোয়া থানার সাতক্ষীরা-যশোর হাইওয়ে রাস্তার ওপর পুলিশ চেকপোস্টে ডিউটি করছিল। সেদিন ইলিশপুর গ্রামের কোটার মোড়ে সাতক্ষীরা-যশোর হাইওয়ে পাঁকা রাস্তার ওপর ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল ডাকাত মনি। এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশ সেখানে ছুটে যায়। ঘটনাস্থল ঘেরাও করলে ডাকাত দলের সদস্যদের মধ্যে শেখ শফিউল্লাহ মনি ওরফে গোল্ড মনি পুলিশের দিকে গুলি করতে থাকেন। এরপর সে সেখান থেকে পালিয়ে যায় বলে পুলিশ দাবি করেছে। পরে এ ঘটনায় গোল্ড মনির বিরুদ্ধে কলারোয়া থানায় ওই দিনই ডাকাতির প্রস্তুতি ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। মনিরের সহযোগী বিজ্ঞ আদালতে জবানবন্দী প্রদান করেন। যেখানে তারা তাদের সর্দার হিসাবে গোল্ড মনিকে চিহ্নিত করে তার নাম ঠিকানা প্রকাশ করে। পুলিশ শফিউল্লাহ মনি ওরফে গোল্ডেন মনিকে গ্রেফতার করার জন্য দেশব্যাপী রেডএ্যালার্ট জারি করে। এছাড়া মনিকে গ্রেফতারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন জেলা পুলিশ সুপার। বর্তমানে গোল্ডেন মনি পলাতক রয়েছে।
শীর্ষ চোরাকারবারী গোল্ডেন মনির আমলনামা

