আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে সময়টা ভালো যাচ্ছে না পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানের। একের পর এক আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। এখন চক্কর কাটতে হচ্ছে আদালতের দ্বারে দ্বারে। তবে সেখানেও সমস্যা। যেমন- মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) একই দিনে চারটি মামলার শুনানিতে স্বশরীরে উপস্থিত থাকার কথা ছিল তার। অথচ সেগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রায় একই সময়ে দুটি ভিন্ন স্থানের চারটি ভিন্ন আদালতে। ফলে এক জায়গার দুটি শুনানিতে স্বশরীরে হাজির হলেও অন্য দুটিতে যাননি বা যেতে পারেননি ইমরান খান। তার জেরে একটি মামলায় জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নামে।
এদিন বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক নিয়ে ইসলামাবাদের জুডিশিয়াল কমপ্লেক্সের দুটি আদালতে হাজির হয়েছিলেন ইমরান খান। তবে আজ চারটি ভিন্ন মামলায় ব্যক্তিগত হাজিরা ছিল পিটিআই চেয়ারম্যানের। এর মধ্যে দুটি ছিল জুডিশিয়াল কমপ্লেক্স আদালতে এবং দুটি এফ-৮ কাছারিতে।
ইমরান খানের নামে বেআইনি অর্থায়ন মামলা এবং সন্ত্রাসবাদ মামলার শুনানি ছিল জুডিশিয়াল কমপ্লেক্সে অবস্থিত আদালতে। আর তোশাখানা মামলা ও হত্যাচেষ্টা মামলার শুনানি ছিল এফ-৮ কাছারির দায়রা আদালতে। জুডিশিয়াল কমপ্লেক্স থেকে এফ-৮ কাছারির দূরত্ব প্রায় আধা ঘণ্টার রাস্তা।
এফ-৮ কাছারিতে অতিরিক্ত দায়রা জজ জাফর ইকবালের আদালতে তোশাখানা মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এই মামলায় ইমরান খানের আইনজীবী আদালতকে অনুরোধ করেন, তার মক্কেলকে আজকের শুনানি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। কারণ তাকে একই সময় আরও কয়েকটি আদালতে হাজির হতে হবে। এর আগে তার বিরুদ্ধে শুনানি দুবার মুলতবি করা হয়েছিল।
শুনানিতে পিটিআই’র আইনজীবী আলি বুখারি আদালতকে বলেন, তার মক্কেল জুডিশিয়াল কমপ্লেক্সের দুটি আদালতে হাজিরা দিতে রওয়ানা দিয়েছেন। তাই তিনি আজ এই আদালতে হাজির হতে পারবেন না। এ জন্য শুনানি পাঁচ দিনের জন্য মুলতবি করার আবেদন করেন বুখারি।
তবে, ইসিপির কৌঁসুলি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, পিটিআই প্রধান আসলে আদালতে হাজির হতে চান না। তিনি আদালতে পৌঁছানোর জন্য কতদূর ভ্রমণ করছেন তা আদালতের দেখার বিষয় নয়। ইমরান খান জুডিশিয়াল কমপ্লেক্সে যেতে পারলে এই আদালতেও হাজির হতে পারবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এসময় পিটিআই’র আইনজীবী বলেন, অন্য দুটি মামলা থেকে মুক্ত হলে তার মক্কেল বিচারিক সময়ের মধ্যে আদালতে পৌঁছাতে পারবেন।
এর প্রেক্ষিতে বিচারক বলেন, অভিযোগ গঠন অপেক্ষমান থাকায় তার এখানেও আসা উচিত। পরে আইনজীবী বলেন, খাজা হারিস এই মামলায় ইমরান খানের প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং তিনি আজ এখানে আসতে পারবেন না।
এরপর শুনানি সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেন বিচারক। পরে শুনানি ফের শুরু হলে তিনি ইমরান খানের নামে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন এবং শুনানি ৭ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করেন।
এ ঘটনার পরপরই ইসলামাবাদ হাইকোর্টে যান ইমরান খান। সেখান থেকে হত্যাচেষ্টা মামলায় আগামী ৯ মার্চ পর্যন্ত আগাম জামিন পেয়েছেন তিনি। এছাড়া পিটিআই প্রধানকে এক লাখ রুপির বেইল বন্ড জমা দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
ইমরানের নামে যত মামলা
হত্যাচেষ্টা মামলা
পিএমএল-এন নেতা মহসিন রাঞ্জার দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, গত ২১ অক্টোবর কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউতে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) অফিসের বাইরে তার দিকে গুলি চালান এক পুলিশ সদস্য। এটি ইমরান খানের নির্দেশে তাকে হত্যার প্রচেষ্টা ছিল বলে অভিযোগ করেছেন মহসিন।
তোশাখানা মামলা
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় তোশাখানা পরিচালনা করে দেশটির মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অন্যান্য দেশের সরকার ও রাজ্যের প্রধান, সংসদ সদস্য, আমলা, কর্মকর্তাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া মূল্যবান উপহার তোশাখানায় সংরক্ষণ করা হয়। নিয়ম অনুসারে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পাওয়া উপহার বা এ জাতীয় অন্যান্য উপকরণগুলোর বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক।
অভিযোগ উঠেছে, পিটিআই সরকারে থাকাকালে ইমরান খানের পাওয়া উপহারের যথাযথ বিবরণ প্রকাশ করেনি। এমনকি এ বিষয়ে পাকিস্তান তথ্য কমিশনের (পিআইসি) নির্দেশও উপেক্ষা করেছিল তারা।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ইসিপি’তে জমা দেওয়া লিখিত জবাবে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার পাওয়া কমপক্ষে চারটি উপহার বিক্রি করার কথা স্বীকার করেন।
সন্ত্রাসবাদ মামলা
গত ২০ অক্টোবর তোশাখানা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ইমরান খানকে সংসদ সদস্য পদের অযোগ্য ঘোষণা করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। এর পরপরই পিটিআই কর্মীরা রাস্তায় নেমে আসে এবং দেশটির বিভিন্ন স্থানে ইসিপি কার্যালয়ের বাইরে বিক্ষোভ করে। এর জেরে ইমরানের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের সাংজানি থানায় সন্ত্রাসবাদের মামলা দায়ের করা হয়।
অবৈধ অর্থায়ন মামলা
ইমরান খান ও তার দল পিটিআইয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ১০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে মামলাটি করেন দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আকবর এস বাবর, যাকে গুরুতর অর্থনৈতিক অনিয়মের জেরে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
মামলার বিবরণীতে বলা হয়, ইমরান খান ও তার দলের ১০ জন জ্যেষ্ঠ সদস্য বিদেশি উৎস থেকে অর্থ নিয়েছেন এবং ঠিক কী উদ্দেশ্যে নিয়েছেন, তা পরিষ্কার নয়।
দীর্ঘ চার বছর মামলাটি নিষ্ক্রিয় পড়েছিল। ২০১৮ সালে পাকিস্তানের মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করে জাতীয় নিরীক্ষা কমিটি। পরের চার বছরে এই অভিযোগের ওপর ৯৫টি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
শেষে ২০২২ সালে জাতীয় নিরীক্ষা কমিটি জানায়, ইমরান খান ও তার দলের অভিযুক্ত ১০ জনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে এবং দলের নেতৃত্ব বিদেশি তহবিল গ্রহণের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করেছেন।
গত আগস্টে মামলার রায় ঘোষণা করে ইসিপি। এতে বলা হয়, পাকিস্তানের আইন লঙ্ঘন করে পিটিআই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি কোম্পানির মাধ্যমে ৩৫১টি বিদেশি কোম্পানি ও ৩৪ জন বিদেশি নাগরিকের কাছ থেকে ‘সজ্ঞানে অনুদান গ্রহণ করেছে’। এছাড়া কানাডা, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশের নিষিদ্ধ উৎস থেকেও তারা অর্থ পেয়েছে।