নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা ভাইরাসের মহামারিতে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থল বন্দরে অর্জিত হয়নি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। একদিকে ব্যবসায়ীরা হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মূখীন অন্যদিকে সরকারও হারিয়েছে বিপুল অংকের রাজস্ব। দীর্ঘ তিন মাস বন্ধ থাকার পর বন্দরের আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম চালু হলেও ফেরেনি কার্যক্রমের স্বাভাবিক গতি। এছাড়াও ভোমরা বন্দর দিয়ে পন্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহ সেটিও রাজস্ব ঘাটতির আরেকটি কারণ।
ভোমরা স্থল বন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি বাণিজ্যের উপর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এক হাজার ১৮৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তবে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৮৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি হয়েছে ৬০২ কোটি ৯৮ লাখ। চলতি ২০২০-২১ অর্থ বছরে আমদানি বানিজ্যের উপর রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার দুই কোটি পাঁচ লাখ টাকা।
বাংলাদেশে করোনা প্রার্দুভাবের শুরুতে গত ২৫ মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশনায় বন্ধ হয়ে যায় বন্দরের আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম। তিন মাস বন্ধের পর আমদানি ও রপ্তানির জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯ জুন। ২০ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আমদানি কার্যক্রমের উপর রাজস্ব আদায় হয়েছে চার কোটি ১১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭৩৪ টাকা। পহেলা জুলাই থেকে চলতি মাসের ২০ জুলাই পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৩ কোটি ২৫ লাখ ২২ হাজার ৭৬১ টাকা। তিন মাস বন্ধের পর বর্তমান পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৭ কোটি ৩৬ লক্ষ ৮৯ হাজার ৪৯৫ টাকা। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ৩৩ কোটি ২৫ লাখ ২২ হাজার ৭৬১ টাকা।
ভোমরা স্থল বন্দর কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা শেখ এনাম হোসেন জানান, করোনা মহামারিসহ নানা কারণে বন্দরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ে ঘটতি রয়েছে ৬০২ কোটি ৯৮ লাখ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, আমদানিকারকরা ভোমরা বন্দর দিয়ে আমদানি অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া করোনার কারণে টানা তিন মাস বন্ধ ছিল ভোমরা বন্দর। তিন মাসে প্রায় ২৬০ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। আমদানিতে ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহ ও করোনার হানা, মূলত দুই কারণে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছ বন্দরে। আমদানিকারকরা আমদানি কমিয়ে দেওয়ার কারণ আমার জানা নেই। সেটি একজন ব্যবসায়ীর নিজস্ব ব্যাপার।
ভোমরা বন্দর দিয়ে বর্তমানে আমদানি হচ্ছে, আঙ্গুর, আপেল, আনার, টমেটো, কমলা, তরমুজ, আম, চাল, পানপাতা, মাছ (শুটকি মাছ ও তাজা মাছ), শুকনা মরিচ, হলুদ, সিরামিক আইটেম, পাথর, ক্যাপসিক্যাম, শিল বাটা, আদা, রসুন, শুকনা ঝাল, খৈল, সয়াবিন ভূসি, তুলা, রাইস ব্যান্ড অয়েল, জিরা, মাছের খাদ্য, আগরবাতি, পিয়াজ, কাঁচা মরিচ, খেজুর।
আমদানিকারকরা ভোমরা বন্দর ব্যবহার কমিয়ে দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন ভোমরা সিএন্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধাক্ষ্য ও এমএন্ডএস ট্রেডার্সের সত্ত¡াধিকারী মাকসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা যেখানে সুবিধা পাবে সেখানেই পন্য আমদানি করবে। ভোমরা বন্দর দিয়ে পন্য আমদানিতে কোন ছাড় দেওয়া হয় না। যার কারণে ভোমরা বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। রাজস্ব খাতেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বেনাপোল বন্দর দিয়ে কাঁচামাল পন্য আমদানি করলে ব্যবসায়িদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। ভোমরা বন্দরে দেওয়া হয় না। বিশেষ সুবিধা বলতে, এক ট্রাক টমেটো আমদানি করলে বেনাপোল বন্দরে পাঁচ টন ছাড়, আনার ১৮ টনে ২-৩ টন ছাড় এভাবে প্রতিটি পন্যে ছাড় দেওয়া হয়। ভোমরা বন্দরে এক কেজিও ছাড় দেওয়া হয় না, আমদানিতে সময়ক্ষেপনসহ নানা অব্যবস্থাপনাও রয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা বেনাপোল বন্দরের ঝুঁকেছে। ব্যবসায়ীদের একটু ছাড় দিলে ব্যবসায়ীরা আবারো ভোমরা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
মাকসুদুর রহমান আরও বলেন, করোনায় বন্দর বন্ধ থাকাকালীন সময়ে সরকার যেমন রাজস্ব হারিয়েছি তেমনি বেকার হয়ে ছিল বন্দরের ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীরা হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মূখীন হয়েছে। বর্তমানে বন্দরে আমদানি ও রপ্তানী কার্যক্রম সচল হলেও পূর্বের ন্যায় বন্দরে সেই স্বাভাবিক গতি ফেরেনি। করোনা মহামারির পূর্বে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩৫০টি পন্যবাহি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতো। আর বাংলাদেশ থেকে ভারতে যেত ১০০ ট্রাক। তবে বর্তমানে ভারত থেকে প্রতিদিন আসছে ২৭৫-৩০০ পন্যবাহি ট্রাক আর ভারতে যাচ্ছে ৪০-৫০টি ট্রাক। বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে সময় ক্ষেপনের কারণে আমদানি ও রপ্তানি কমেছে।
ভোমরা স্থল বন্দরের সিএন্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম বলেন, ১৯৯৬ সালে ভোমরা বন্দর প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি টাকা। এখন হাজার কোটি টাকার বেশী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। মূলত বন্দর দিয়ে ৭৫টি পন্য আমদানির সুযোগ থাকলেও বাস্তবে ২৫-৩০ পন্য আমদানি হয়। পাশর্^বর্তী সোনা মসজিদ ও বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে ভোমরা বন্দরের প্রতিযোগিতা চলে শুরু থেকেই। পূর্বে বেনাপোল বন্দর দিয়ে কাঁচামাল ও ফলমূল আমদানি হতো না। ব্যবসায়ীরা ভোমরা বন্দর দিয়ে আমদানি করতো। বর্তমানে বেনাপোল বন্দর দিয়ে কাঁচামাল ও ফলমূল আমদানি হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীক সুবিধার্থে অনেক ব্যবসায়ীরা এখন বেনাপোল বন্দর দিয়ে পন্য আমদানি করায় ভোমরা বন্দরের রাজস্ব কমেছে। ব্যবসায়ীরা যেখানে বেশী সুবিধা পাবে সেখানে ঝুঁকবে এটিই স্বাভাবিক।
তবে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ভোমরা বন্দরের ডেপুটি ডাইরেক্টর মনিরুল ইসলাম জানান, অতীতে কি হয়েছে জানি না। তবে বর্তমানে বন্দরে যে কোন অনিয়ম ও দূর্ণীতির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করা হয়েছে। এভাবেই চলবে আমি যতদিন থাকবো।
তিনি বলেন, করোনায় ভোমরা বন্দরের রাজস্ব খাতে কোন ঘাটতি হয়নি। কাস্টমসে রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে তবে বন্দরে কোন ঘাটতি নেই। করোনার পূর্বে ও বর্তমানে বন্দর স্বাভাবিক গতিতে সব কার্যক্রম চলছে। ব্যবসায়ীদের অব্যবস্থাপনা অভিযোগটি সঠিক নয়। এছাড়া অন্য বন্দরে ছাড় দেওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা সেদিকে ঝুঁকছে সেটিও আমি জানি না।
আমদানিতে অনাগ্রহ ও করোনায় তছনছ ভোমরা বন্দরের রাজস্ব খাত
পূর্ববর্তী পোস্ট