আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: করোনাভাইরাস মহামারি হানা দেওয়ার এক বছরের মাথায় ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে চীনের অর্থনীতি। যদিও এই অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সরকারের নেওয়া ঋণ এবং চীনা ধনীদের ব্যয় করা বিপুল পরিমাণ অর্থ। কিন্তু পান রুন পিং-এর মতো সাধারণ চীনা নাগরিকদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে সুখবর।
পান রুন পিং থাকেন সাংহাই-এর একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে, কাজ করেন পানশালা এবং রেস্তোরাঁয়। তিনি কাজে ফিরে গেছেন। কিন্তু বিদেশে চীনাদের যেভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন পান রুন পিং।
তার ভাষায়, ‘যেসব চীনা বিদেশে বসবাস করেন, আমি চাই না তারা হয়রানির শিকার হোক। আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক আছি, বিদেশে থাকা চীনারা তো কোনও দোষ করেনি।’
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে চীনের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ার পর এক বছর কেটে গেছে। দ্বিতীয় বছরে পড়েছে চীন। ২৭ বছর বয়সী পান তার পানশালায় মদ বিক্রি করেন।
তার থেকে এক বছরের বড় ঝৌ সি ই চামড়ার ব্যবসা করেন। তার সাততলার ফ্ল্যাট বাড়িতেই ঝৌ-এর স্টুডিও। সেখান থেকে তিনি চামড়ার হাতব্যাগ আর ওয়ালেট বানান। তিনি বলেন, তিনি খুবই দেশপ্রেমী। তার মা ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।
ঝৌ সি ই বলেন, চীনে অথনীতির ভিত ‘শক্ত পাথরের মতো, ভাইরাস তাকে পরাস্ত করতে পারবে না।’ তবে তিনি বলেন, এই ভাইরাসের বিস্তার যে চীন থেকে ঘটেছে সেজন্য ‘অবশ্যই চীনের দুঃখিত হওয়া উচিত।’
চীনে করোনাভাইরসে আক্রান্তের সরকারি হিসাব নিয়ে প্রথম দিকে ব্যাপক সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা যাই হোক, দেশটি দ্রুত এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে।
ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশটির কোনও কোনও অঞ্চলে কঠোর লকডাউন দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উন্নত নজরদারি ব্যবস্থা ও গণহারে পরীক্ষা চালানো হয়েছে। চীনের মত এতো ব্যাপক মাত্রায় পরীক্ষা দুনিয়ার আর কোনও দেশে চালানো হয়নি।
ট্র্যাকিং ও ট্রেসিং বা আক্রান্তদের চিহ্ণিত করে তাদের এবং কারা তাদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছে সেটা খুঁজে বের করাই চীনের সাফল্যের বড় চাবিকাঠি। আর এর মাধ্যমেই চীনের অর্থনীতির দ্রুত পুনরুজ্জীবন ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ঝৌ-এর মতো ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য এটা সত্যিকারের সুখবর। মানুষ নতুন করে তাকে ব্যাগের অর্ডার দিতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার যে গাড়ি নির্মাণ সংস্থায় তার স্বামী কাজ করে সেখানে আবার ক্রেতার ভিড় বাড়তে শুরু করেছে।
তিনি মনে করেন, চীনের সাফল্যের একটা গোপন চাবিকাঠি রয়েছে যেভাবে দেশটি পরিচালনা করা হয় তার মধ্যে। আমাদের নেতা একজন- পার্টির সচিব- সবাই তাকে মানে, এটাই আসল কথা।
প্যানডেমিক ছড়ানোর ক্ষেত্রে চীন ভুল করেছে কিনা, বা ভাইরাস সে দেশ থেকে ছড়ানোয় দেশটি কেন দুঃখপ্রকাশ করেনি, এগুলো রাজনীতির ব্যাপার বলে ঝৌ মনে করেন।
তার ভাষায়, ‘সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের খারাপ লাগে। আমরা দুঃখ প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু নেতারা হয়তো অত সহজে সেটা করতে পারেন না। তার হয়তো কারণ থাকতে পারে।’
বড় কথা হলো চীনের সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হয়েছে দ্রুত গতিতে।
অনেকে এটাকে দৃঢ় হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষণ হিসেবে দেখছেন। অনেক পর্যবেক্ষক আবার বলছেন, অর্থনীতি সবক্ষেত্রে সমানভাবে সচল হয়নি।
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল পেট্টিস বলেছেন, ‘চীনের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন অনেকটা একপেশে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রায় পুরোটাই সরবরাহের ক্ষেত্রে- উৎপাদনের ক্ষেত্রে। কিন্তু অর্থনীতির চাহিদার দিকে সেভাবে উন্নতি দেখা যায়নি।’
তিনি বলছেন, চীন সরকার অবকাঠামো বা শিল্প উৎপাদন চালু রাখতে প্রথমেই ঋণের অর্থ জুগিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর যে কৌশল নিয়েছে সেটি এই ভারসাম্যহীনতার একটা কারণ।
অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপক পেট্টিস মনে করছেন, এর ফলে উৎপাদন হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু বাজারে কেনার মতো গ্রাহক তুলনামূলকভাবে কম। যারা অর্থ ব্যয় করতে শুরু করেছেন তারা কিনছেন নতুন গাড়ি বা তারা বিমান ভ্রমণের দিকে ঝুঁকছেন।
পিকিং ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পেট্টিস মনে করেন, চীনে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হয়েছে একপেশেভাবে। পানশালার কর্মী মিস পান-ও এ কথার সমর্থন করলেন। তিনি বলছেন, তাদের পানশালা বিত্তশালীদের জন্য অর্থাৎ একটু দামী পর্যায়ের। সেখানে অনেক মানুষ ফেরত আসতে শুরু করেছেন। তবে এরা হলেন এমন মানুষ যাদের পকেটে অর্থ আছে।
পান অবশ্য তাতে সন্তুষ্ট হয়ে বসে নেই। তিনি অর্থ সঞ্চয় করতে শুরু করেছেন। তিনি বলছেন, ‘এ বছর চাকরির বাজার বেশ খারাপ। আমাদের মতো যারা অভিবাসী কর্মী, অর্থাৎ অন্য রাজ্য থেকে চাকরি করতে বড় বড় শহরগুলোতে আসছি, আমাদের জন্য এটা খুবই কঠিন সময়।’
পান দক্ষিণ চীনের ইউনান প্রদেশের বাসিন্দা- যার দূরত্ব সাংহাই থেকে এক হাজার মাইলের বেশি। পান রুন পিং-এর মতো চীনের কয়েক কোটি মানুষ ভালো চাকরির খোঁজে এবং উন্নত জীবনের আশায় বড় শহরগুলোতে পাড়ি জমান। তবে করোনার কারণে ব্যবসা বাণিজ্য সব বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং তারপর অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব, পান-এর মতো পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
করোনা মহামারির অভিঘাতে পানের কিছু বন্ধু নিজেদের শহরে বা গ্রামে চলে গেছেন। তারা আর সাংহাইতে ফেরত যাননি। তারা স্থানীয়ভাবে সরকারি চাকরি নিয়েছে বা সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ নিয়েছে। কারণ তারা জানে, সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য এক ধরনের নিশ্চয়তা রয়েছে।
পানশালার কর্মী মিস পান-এর ভাষায়, ‘আমি যদি আমার নিজের শহরে ফিরে যাই, আমিও কিন্তু চাইবো সরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিতে। কারণ সরকারি চাকরি নিরাপদ এবং এটি আমাকে জীবনে একটা স্থায়ী নিরাপত্তা দেবে।’ কিন্তু পান সাংহাইতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি চাইছেন তার নিজের পানশালার ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যেতে।
এটা খুবই স্পষ্ট যে ভাইরাস মহামারির আগে চীনে যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিবেশ ছিল, সেটা মানুষ আবার অনেকাংশে ফিরে এসেছে। অর্থনীতি এতোটাই স্থিতিশীল হয়েছে বলে সরকার মনে করছে যে, তারা তাদের পরবর্তী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আর্থসামাজিক কৌশলের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এটাও স্পষ্ট যে, ২০২০ সালে চীনই হতে যাচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র বড় অর্থনীতির দেশ যাদের অর্থনীতি উর্ধ্বমুখী হয়েছে বলে দেখা যাবে। সূত্র: বিবিসি।