প্রধান প্রতিবেদক: উপকূলীয় এলাকায় ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক ইদ্রিস আলী। অবহেলিত ঝরে পড়া শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে “স্কুল অব হিউম্যানিটি” নামের একটি শিক্ষাদান কেন্দ্র চালু করেছেন তিনি। সেখানে শিক্ষার আলো পাচ্ছে উপকূলীয় এলাকার ঝরে পড়া শিশুরা।
সুন্দরবন উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালি বাজারে শুক্রবার বিকেল ৩টা-৫টা পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয় এসব শিশুদের। ইতোমধ্যে এলাকায় বেশ সাড়াও ফেলেছে হিউম্যানিটি স্কুলটি। কোন ঘর নেই স্কুলটির। পাতাখালি বাজারের একটি পরিত্যাক্ত চান্নিতে ছুটির দিনে পাঠদান দেওয়া হয়।
পাতাখালি বাজারের চায়ের দোকানদার সারাফাত হোসেন। কয়েকবছর আগে গাছ থেকে পড়ে দূর্ঘটনায় তিনি পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তার সাত বছর বয়সী ছেলে তাসফিরুল ইসলাম এই স্কুলটির নিয়মিত শিক্ষার্থী।
চায়ের দোকানদার সারাফাত হোসেন জানান, আমরা গরীব মানুষ। ছেলেকে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাড়িয়েছি। পরবর্তীতে গাছ থেকে পড়ে আমি পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর ছেলের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। একদিকে পরিবারে অভাব অন্যদিকে চায়ের দোকান পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য। সেজন্য ছেলে চায়ের দোকানে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করে। পরবর্তীতে দুই মাস আগে হিউম্যানিটি স্কুলের যুবকদের আহব্বানে ছেলেকে সেখানে ভর্তি করে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, প্রতি শুক্রবার বিকেলে ছেলে ওই স্কুলে যায়। সেখানে খেলাধূলার মাধ্যমে বাচ্ছাদের শিক্ষা দেওয়ার কার্যক্রম করা হয়। ছেলেটাও শুক্রবার আসলেই স্কুলে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এলাকার আমার মত অনেক গরীব পরিবারের ঝরে পড়া শিশুও সেখানে পড়ছে।
স্কুল অব হিউম্যানিটি নামের এই শিক্ষাদান কার্যক্রমের পরিচালক সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক ইদ্রিস আলী জানান, নানা কারণে উপকূলীয় এলাকার শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্জিত হয়। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়েই তাদের বেড়ে উঠতে হয়। পারিবারিক দৈন্যদশাসহ বাবা-মায়ের পারিবারিক সমস্যার কারণেও সন্তানটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠাণ থেকে ঝরে যায়। বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে যাওয়া এসব শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোসহ আবারো তাদের বিদ্যালয়ে ফিরে দেয়াটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আর যেসব শিশুদের আর বিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই তাদেরকে মৌলিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা।
তিনি বলেন, গত দুই মাস আগে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালি বাজারের পরিত্যাক্ত চান্নিতে প্রতি শুক্রবার বিকেলে পাঠদান করা হয়। বর্তমানে এলাকার ৩০ জন ঝড়ে পরা শিশুকে আমরা পাঠদান দিচ্ছি। মানবিক কারণেই বিদ্যালয়টি পরিচালনা করছি। শুক্রবার বিকেলে ওইসব শিশুরা ছাড়াও আশেপাশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও উপস্থিত হয় এখানে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমান, পাতাখালি মাদরাসার ইংরেজি শিক্ষক ইয়াছিন আলী, স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জিএম মাহমুদুন্নবী ও প্রবাসী আব্দুল্লা আল মাসুদকে উপদেষ্টা করে স্কুলটি পরিচালনা করা হচ্ছে।
প্রভাষক ইদ্রিস আলী আরও জানান, শিক্ষার্থীদের বয়স উপযোগী শিক্ষামূলক আকর্ষণীয় ভিডিও দেখানো, ভিডিওর প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্লাসে মনোযোগী ও পরবর্তীতে স্কুলের প্রতি আকৃষ্ট করা, খেলাধুলা ও ধাধার মাধ্যমে তাদেরকে গণিত বিষয়ের মৌলিক ধারণা সৃষ্টি করা, গান, কৌতুক ও অভিনয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগী ও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরী করা, ভিডিও কার্টুন দেখানোর পাশাপাশি ছবিযুক্ত ছোটগল্পের বই পড়তে উৎসাহিত করা, ক্লাস শেষে ১০ মিনিটের একটি খেলা বা অন্য কোনো জ্ঞানমূলক প্রতিযোগিতা করে পুরস্কার দেওয়া এছাড়া ক্লাস শেষে খাবারের ব্যবস্থা। ঝড়ে পড়া শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে এভাবেই পরিচালনা করা হচ্ছে স্কুলটি।
স্কুলটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিষয়ে প্রভাষক ইদ্রিস আলী বলেন, ঝরেপড়া অথবা অর্থাভাবে স্কুলের চৌকাঠ না মাড়ানো শিশুদের বিনোদনের মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরী করে তাদেরকে আবার মূলধারার স্কুলে ফেরত পাঠানো। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ও সুন্দরবন রক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরীতে ভূমিকা রাখতে তৎপর করা। এসবের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন উপকূলবর্তী অঞ্চলের ঝরেপড়া শিশুদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তাদের জীবনকে পরিবর্তন করা।
স্কুলটির বিষয়ে পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, উপকূলীয় এলাকায় একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগের আঘাতে সর্বসান্ত হয়ে গেছে মানুষ। আইলা, সিডর, ফনি, বুলবুল এসব দূর্যোগের কারণে মানুষ দিশেহারা। এলাকার অধিকাংশ মানুষ গরীব ও নিম্ন শ্রেণির। অভাবের তাড়নায় ছেলে মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারে না। জীবিকার তাগিদে একটু বেড়ে ওটার সঙ্গে সঙ্গে যে কোন কাজে লাগিয়ে দেয়। হিউম্যানিটি স্কুলটি শুরুর মধ্য দিয়ে এলাকার বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া শিশুরা নতুন করে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে ৩০ জন ঝড়ে পড়া শিশুকে একত্রিত করে পাঠদান করানো হচ্ছে। ধীরে ধীরে এর সংখ্যা আরও বাড়বে। এমন বিদ্যালয়টির প্রয়োজন ছিল আগেই।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম কামরুজ্জামান বলেন, স্কুলটির বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। আপনার কাছ থেকেই প্রথম জানলাম। তবে উপকূলীয় এলাকায় ঝরে পড়া শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর বিষয়টি প্রশংসনীয়। উপজেলা প্রশাসন স্কুলটির বিষয়ে খোঁজ নেবে। এছাড়া সরকারিভাবে সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে কিনা সেটি বিবেচনা করা হবে।
ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার আলো দিচ্ছে “স্কুল অব হিউম্যানিটি”
পূর্ববর্তী পোস্ট