আহাদুর রহমান (জনি): যুদ্ধ না করলেও মুক্তিযোদ্ধার সাময়িক সনদ ঘষামাজা করে পিতাকে গেজেট ভুক্ত করার অভিযোগ উঠেছে। মৃত ললিত মোহন সাহার জিবদ্দশায় ও বর্তমানে তার ছেলেরা তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর জন্য অসামঞ্জস্য কাগজপত্র ও সাক্ষী উপস্থাপন করে চলেছে বলে অভিযেগ আছে। অন্য দিকে একটি পক্ষ আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তালা উপজেলার ধানদিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের মৃত বসন্ত সাহার ছেলে মৃত লোলিত মোহন সাহা জীবদ্দশায় নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে একাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রস্তুত করেন। যার একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সাময়িক সনদপত্র, যার স্মারক নং-মুবিম/সা/খুলনা/প্র-৩/৪৫/২০০২/৩৯০, তারিখ-১৯-০৪-২০০৩। যার সার্টিফিকেট নং-১৪৮৬০। সাময়িক সনদপত্র গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ১৫ মে যুদ্ধকালীণ খুলানা বিভাগের লে: অবসরপ্রাপ্ত গাজী রহমতুল্লাহ’র কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ করেন। ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন ললিত মোহন সাহা। এরপর তার মৃত্যুর ৫ বছর পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে আতাউল গনী ওসমানী স্বাক্ষরিত দেশরক্ষা বিভাগের স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র। একই বছরের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তালা উপজেলা সংসদের কমান্ডার মফিজ উদ্দিনের নিকট থেকে তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়ন পত্র, দু’দিন পর ৬ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলা ইউনিট কমান্ডার মোশারফ হোসেন (মশু), একই বছরের ১৫ জুলাই ধানদিয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও দক্ষিণ শারসা গ্রামের মৃত ফকির আহাম্মেদ গাজীর ছেলে মো: তবিবর রহমানের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যায়নপত্র গ্রহণ করেন।
তবে প্রত্যয়নের বিষয়ে কিছু জানেনা সাতক্ষীরা জেলা ইউনিট কমান্ডার মোশারফ হোসেন (মশু)। একই ভাবে তবিবর রহমান প্রত্যায়ন দেওয়ার পর জানতে পারেন যে, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। মূলত লোলিত মোহন সাহার ছেলেরা তাকে বিভিন্ন জাল সনদসহ ভূয়া প্রত্যায়নপত্র দেখিয়ে তার কাছ থেকে প্রত্যায়নপত্রটি গ্রহণ করেছেন।
ললিত মোহন সাহা পক্ষে যে সাময়িক সনদ উপস্থান করা হয়েছে তার নং ১৪৮৬০। সেই ১৪৮৬০নং সনদটি খুলনা জেলা সদরের ২৩, আজিজুর রহমান সড়কের ইয়াকুব হোসেনের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা তারেক সৈয়দ আলী হাসানের নামে নিবন্ধিত। মূলত তার সাময়িক সনদটি ঘষামাজা করে ললিত তৈরি করে তার মুক্তিযোদ্ধার সাময়িক সনদ। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই শেষে সাময়িক সনদ দেয়া হয়। কিন্তু ললিত মোহন সাহার সন্তানরা যাচাই বাছাই কার্যক্রমে সেই জাল সাময়িক সনদ উত্থাপন করে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টায় আছে। অন্যদিকে ললিত মোহন সাহার নামে যে সাময়িক সনদ উপস্থাপন করা হয়েছে তাতেও আছে জালিয়াতির বিস্তর প্রমান।
ললিত মোহন সাহার অর্ন্তভূক্তি প্রসংঙ্গে আপত্তি জানিয়ে ৩’অগাস্ট ২০২২ খ্রিঃ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) তে বীর মুক্তিযোদ্ধা জেলা কমান্ডের সহ-কমান্ডার আলহাজ্ব মোড়ল আব্দুর রশিদ, তালা উপজেলার সাবেক কমান্ডার এম এম ফজলুল হক, তালা উপজেলা ডেপুটি কামান্ডর মোঃ আলাউদ্দীন জোয়ার্দার, তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপদেষ্টা অধ্যাপক মোড়ল আবু বকর, তেতুলিয়া ইউনিয়ন কমান্ডার নজীর উদ্দীন মোড়ল, তালা উপজেলা সাংগঠনিক কমান্ডার মোঃ তবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি আবেদন করা হয়। আবেদনে মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মৃত ললিত মোহস সাহা আদৌ কোন মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। যে সকল স্বাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছে তাও তাদের অনলাইন আবেদনের ডিজির সাথে মিল নেই। অললাইন আবেদনে মুজিব বাহিনী হিসেবে আবেদন করলেও যে স্বাক্ষী উপস্থাপন করা হয়েছে তা ২ জন নৌ-কমান্ডের ও ১জন মুক্তিযোদ্ধার। নীতিমালা অনুযায়ী তার একই গ্রুপের সহযোাদ্ধা হওয়া আবশ্যক ছিলো। এ ছাড়া মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে দাবী করলে তার স্বপক্ষে তোফায়েল আহম্মেদ ও তসলিম আহম্মেদ স্বাক্ষরিত সনদ দাখিল করা আবশ্যক ছিলো। কিন্তু তার পরিবর্তে স্বাধীনতা সংগ্রামের দেশরক্ষা বিভাগের আতাউল গণি ওসমানি সনদ দাখিল করেছে, যা বীর প্রতীক লেঃ(অবঃ) গাজী রহমতুল্লাহ প্রতিস্বাক্ষরিত। কিন্তু ওসমানি সনদে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহের প্রতিস্বাক্ষর থাকার কথা। অন্যদিকে ১৯৭৩ সালে ইস্যুকৃত আতাউল গণি ওসমানি সনদে জেলা হিসেবে সাতক্ষীরা উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময় সাতক্ষীরা একটি মহকুমা ছিলো। পূর্ণাঙ্গ জেলা সাতক্ষীরা ঘোষণা করা হয় ১৯৮৪ সালে। এখানে প্রমাণ হয় ললিত মোহন সাহার পক্ষে উপস্থাপন করা সাময়িক সনদটি ঘষামাজা ও জাল করে প্রস্তুত করা হয়। ভূয়া সনদ উপস্থাপন করে তালা উপজেলা সাংগঠনিক কমান্ডার মোঃ তবিবুর রহমানের কাছ থেকে প্রত্যয়ন নেওয়ায় তিনি আদালতের দারস্ত হন। তবিবুর রহমান ললিতের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ও তার দেওয়া প্রত্যায়নপত্রটি নিয়ে সাতক্ষীরা আমলী আদালতে প্রতাপ কুমার সাহা ও তার ভাই বীরেন্দ্র নাথ সাহার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। যার নং সিআর-১৯৬/২০(পাট), ধারা: ৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/৪১৭ ও ১১৪ দ:বি:।
আদালত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআই সাতক্ষীরাকে নির্দেশ প্রদান করেন। পিবিআই তদন্তকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিব (সনদ) ডা: দুলাল কৃষ্ণ রায় স্বাক্ষরিত স্মারক নং ৪৮.০০.০০০০.০০৩.৫০.০৩০.১৮.৬১ তারিখ-২৩/০২/২০২১ এর মাধ্যমে জানানো হয় সাময়িক সনদপত্রটি সঠিক নয়।
এ বিষয়ে অভিযোগ মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সচিব নিয়ে তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার বিশ্বাসের কাছে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা তবিবুর রহমান। কিন্তু তার অভিযোগ ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তৈরি করা জাল কাগজপত্র দেখতে অসীকৃতি জানান নির্বাহী কর্মকর্তা। এ বিষয়ে জানতে তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ললিত মোহন সাহার আবেদনের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুস সোবাহান জানান, ললিত মোহন সাহার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অর্ন্তভূক্তির জন্য যে সকল কাগজপত্র আমাদের কাছে জমা দিয়েছেন তার সবগুলোই জাল। এখন অনলাইনের যুগ। তার পক্ষে প্রদর্শিত সাময়িক সনদ অনলাইনে সার্চ করলে অন্য ব্যক্তির নাম আসে। তিনি আরও জানান একটি মহল আর্থিক সুবিধা নিয়ে ললিত মোহন সাহাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে।
এই ভাবে প্রতারণার আশ্রয় লোলিত মোহন সাহা ও পরবর্তীতে তার ছেলেরা বার বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম ওঠানোর অপচেষ্টা করেই যাচ্ছে।
তালায় ভূয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অর্ন্তভূক্তির চেষ্টা
পূর্ববর্তী পোস্ট