অনলাইন ডেস্ক :
বরগুনার বহুল আলোচিত শাহনেওয়াজ শরীফ ওরফে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় নিহতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। আর মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড আগেই বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। মূলত মিন্নির ত্রিভুজ প্রেমের জেরে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বলে মামলার অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে।
২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার পর ১ সেপ্টেম্বর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবির।
প্রেমিক রিফাতের মাধ্যমেই নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির পরিচয়
অভিযোগপত্রের তথ্যানুযায়ী, রিফাত শরীফ ছিলেন বরগুনা থানা এলাকার একজন ডিশলাইন ব্যবসায়ী। ২০১৭ সালে রিফাতের সঙ্গে আয়্শা সিদ্দিকা মিন্নির প্রেম শুরু হয়। রিফাত বরগুনা জিলা স্কুলে পড়ালেখা করেছিলেন। সেই স্কুলে তার সহপাঠী ছিল নয়ন বন্ড। সেখান থেকেই নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাত শরীফের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এতে বন্ধু নয়ন বন্ডের সঙ্গে প্রেমিকা মিন্নির পরিচয় করিয়ে দেন রিফাত শরীফ। তখন আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে ভালো লেগে যায় নয়ন বন্ডের।
যেভাবে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির সম্পর্ক
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালে রিফাত শরীফ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেড় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময় প্রেমিককে পাশে না পেয়ে নয়ন বন্ডের সঙ্গে নতুন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে মিন্নি। তখন নয়ন বন্ড এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিল।
নিজের আধিপত্যের কারণে ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে মিন্নিকে গোপনে বিয়ে করে নয়ন বন্ড। তখন বন্ধু রিফাত শরীফের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি বেমালুম ভুলে যায় নয়ন। গোপনে বিয়ের কিছুদিন পর একটি মামলায় নয়ন বন্ড কারাগারে চলে যান। আর নয়ন বন্ডের অনুপস্থিতিতে আগের বিয়ে লুকিয়ে ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল পুরনো প্রেমিক রিফাতকে বিয়ে করে মিন্নি।
একইসঙ্গে দুই স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায়
অভিযোগপত্রের তথ্যানুযায়ী, রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ে পরই জামিন পেয়ে যায় নয়ন বন্ড। আর সেই সময় চতুরতার আশ্রয় নেয় মিন্নি। সে দুই স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতো। নয়ন বন্ডের বাড়িতে গিয়ে শারীরিক সম্পর্ক বজায়ও রাখতো মিন্নি। এক পর্যায়ে সেই বিষয়টি জেনে যান রিফাত শরীফ। এ নিয়ে মিন্নির সঙ্গে রিফাতের মনোমালিন্য শুরু হয়। তখন মিন্নি রিফাতের কাছে ডিভোর্স চায় এবং নয়ন বন্ডের কাছে ফিরে যেতে চায়।
যেভাবে হত্যার পরিকল্পনার সূত্রপাত
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, রিফাতের সঙ্গে বিয়ের আগে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নয়ন বন্ড নিজের জন্মদিন পালন করেন। ওই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মিন্নি। সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করেছিলেন নয়ন বন্ডের বন্ধু হেলাল শিকদার। এ ভিডিও তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেন।
এটি দেখে রিফাত ২৪ জুন হেলাল শিকদারকে ডেকে নিয়ে ভিডিওটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ও তার মোবাইল ফোনটি নিয়ে যান। পরে হেলাল বিষয়টি নয়ন বন্ডকে জানান। নয়ন বন্ড বিষয়টি সহযোগী রিফাত ফরাজীকে জানান।
রিফাত ফরাজী মিন্নির স্বামী রিফাত শরীফের কাছে মোবাইল ফোনটি ফেরত চাইলে রিফাত তাকে গালাগাল করেন। বিষয়টি মিন্নিকে জানান নয়ন বন্ড। এ নিয়ে মিন্নির সঙ্গে রিফাত শরীফের ঝগড়া হয় এবং এক পর্যায়ে রিফাত শরীফ মিন্নির তলপেটে লাথি মারেন। এতে ক্ষুব্ধ মিন্নি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ফোনে ঘটনাটি নয়ন বন্ডকে জানান এবং পরদিন ২৫ জুন কলেজে যাওয়ার নাম করে নয়ন বন্ডের বাড়িতে যান।
সেখানে মিন্নি পথের কাঁটা দূর করার জন্য নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। মিন্নির কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে নয়ন বন্ড ওই দিন বিকেলে বরগুনা সরকারি কলেজের শহীদ মিনারে আসামিদের সঙ্গে বৈঠক করে রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। একইসঙ্গে আসামিদের পরদিন সকালে কলেজের সামনে উপস্থিত থাকতে বলেন।
যেভাবে রিফাতকে হত্যা করা হয়
হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর বর্ণনা দিয়ে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২৬ জুন সকালে মিন্নি বরগুনা সরকারি কলেজের সায়েন্স বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে আসামি রিফাত ফরাজী, রাব্বি আকন ও রিফাত হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করেন। আসামিদের খালি হাতে দেখে মিন্নি বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং রিফাত ফরাজীর কাছে জানতে চান, তারা খালি হাতে কেন এবং রিফাত শরীফকে কী দিয়ে মারবে? ওই সময় মিন্নিকে নিতে কলেজের গেটে আসেন রিফাত শরীফ। তখন মিন্নি রিফাত শরীফের সঙ্গে কলেজের গেটের সামনে রাখা মোটরসাইকেলের কাছে যান।
কিন্তু পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গেটের আশপাশে থাকা আসামিদের সুযোগ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এবং সময়ক্ষেপণ করার জন্য মিন্নি পুনরায় কলেজে ফিরে যান। এ সময় মিন্নিকে ফেরাতে রিফাত শরীফ পেছনে পেছনে কলেজের দিকে যান। তখন রিফাত শরীফের ওপর হামলা করার জন্য আসামিদের ইশারা দেন মিন্নি। আসামি রিফাত ফরাজীসহ অন্যরা মিন্নির স্বামীকে জাপটে ধরে মারতে মারতে টেনে-হিঁচড়ে ক্যালিক্স একাডেমির সামনে নিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় মিন্নি স্বাভাবিকভাবে তাদের পেছনে হেঁটে যান।
অভিযোগপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, আসামি রিফাত ফরাজী দৌড়ে গিয়ে পূর্ব পাশের দেয়ালসংলগ্ন গলির মুখে জনৈক নুরুল হকের বারান্দার টিনের চালের ওপরে রাখা ব্যাগের মধ্য থেকে দুই হাতে দুটি বগি দা নিয়ে আসেন। একই সময় আসামি টিকটক হৃদয় ও রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার দৌড়ে গিয়ে দুটি লাঠি নিয়ে আসেন।
আসামি রিফাত ফরাজী একটি দা রাস্তার ওপরে রেখে অন্যটি দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এ সময় রিফাত ফরাজীর হাত থেকে বগি দা নিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন নয়ন বন্ড। আসামি রিফাত ফরাজী তখন রাস্তার ওপরে রাখা অন্য দা নিয়ে পুনরায় রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন।
আসামি রিশান ফরাজী তখন রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখেন। আসামি টিকটক হৃদয় ও রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার লাঠি হাতে হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্ন করার জন্য পাহারা দেন। ওই সময় আসামি মোহাইমিনুল ইসলাম, সিফাত, মো. নাজমুল হাসান, প্রিন্স মোল্লা, আবু আবদুল্লাহ রায়হান, আল কাইয়ুম রাব্বি আকন, নাঈম, অলি উল্লাহ অলি, রাকিবুল হাসান নিয়ামত, জয় চন্দ্র সরকার ওরফে চন্দন, মো. হাসান, মারুফ বিল্লাহ ওরফে মহিবুল্লাহ, মো. মুসা, মারুফ মল্লিক ও রাতুল সিকদার জয় পাহারা দেন। আসামি মিন্নি শুরুতে স্বাভাবিক থাকলেও পরে দায় এড়ানোর জন্য কৌশলে রিফাতকে বাঁচানোর অভিনয় করেন এবং শুধু নয়ন বন্ডকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। এরপর লোকজন জড়ো হলে তারা পালিয়ে যান।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মিন্নি ঘটনার দায় এড়াতে যেহেতু স্বামীকে বাঁচানোর অভিনয় করেন, এ কারণে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আসামিরা মিন্নিকে আঘাত করেননি। এ সময় রক্তাক্ত রিফাত শরীফ একাই রিকশায় করে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলেও মিন্নিকে তখন রাস্তায় পড়ে থাকা তার ভ্যানিটি ব্যাগ ও জুতা কুড়াতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
পরে মিন্নি রিকশায় করে রিফাত শরীফের সঙ্গে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর মুমূর্ষু রিফাত শরীফকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বলেন চিকিৎসকেরা। তখন মিন্নি তার জামাকাপড় রক্তে ভেজা, তাই বরিশাল যাওয়া সম্ভব নয়-এই অজুহাত দেখিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে চলে যান এবং হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নয়ন বন্ডকে মোবাইল ফোনে দ্রুত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি মিন্নি, রিফাত ফরাজী, রাশিদুল হাসান রিশান, মো. হাসান, টিকটক হৃদয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া ১৬১ ধারায় রেকর্ড করা সাক্ষীদের জবানবন্দি, বস্তুগত প্রমাণ, সিসিটিভি ফুটেজ, সিডিআর এবং সার্বিকভাবে পারিপার্শ্বিক অবস্থাগত সাক্ষ্যে প্রাপ্ত তথ্যে আসামি মিন্নির বিরুদ্ধে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
গত বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড ও চারজনের খালাসের রায় দেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান। রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি, রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি, আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান।
খালাস প্রাপ্তরা হলেন- রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মো. সাগর, কামরুল ইসলাম সায়মুন, মো. মুসা।
মিন্নির ত্রিভুজ প্রেমের জেরেই বন্ধু রিফাত শরীফের সঙ্গে নয়ন বন্ডের সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। পরে মিন্নির আবদারে বন্ধু রিফাতকে হত্যা করেন নয়ন। তবে তিনিও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। দুই প্রাণ ঝরার পর আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত। এই ছয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এখন কারাগারের কনডেম সেলে সময় পার করছেন।
সূত্র-ডেইলি বাংলাদেশ