শ্যামনগর ব্যুরো: আইলার পর থেকেই জেলার উপকূলীয় এলাকায় শুরু হয় সুপেয় পানির তীব্র সংকট। এবারও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সীগঞ্জ,বুড়িগোয়ালীনি, আটুলিয়া, শ্যামনগর সদর, ঈশ্বরীপুর, রমজাননগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, আনুলিয়া এবং কালিগঞ্জের কিছু এলাকায় চলছে বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার। এনজিওদের দেওয়া বিশুদ্ধ পানির ফিল্টারগুলো অকেজো হয়ে পড়ায় পানি সংগ্রহ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির অভাবে এসব এলাকায় বাড়ছে বিবিধ রোগ। নোনা পানির কারণে ফসল হচ্ছে না। মরে যাচ্ছে গাছপালা। ফলে এলাকার মানুষ জীবিকার তাগিদে চলে যাচ্ছেন অন্যত্র। লবণাক্ত পানির জন্য নারীদের অকাল গর্ভপাত ঘটছে বলেও মনে করছেন স্থানীয়রা। গত ১০ বছরে শ্যামনগরের ১২ ইউনিয়নের জন সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৬ হাজার ৪৭৩জন। বেড়েছে নারীর সংখ্যা ১১ হাজার ৩২৬জন, অপরদিকে পুরুষের সংখ্যা কমেছে ৬৮৫৩ জন। শুধু শ্যামনগর নয়, সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে পুরো জেলা। জেলার ৬৭ ভাগ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে, সরকারিভাবে এ তথ্য দেওয়া হলেও সুপেয় পানি পান করতে পারছেন না ৫০ ভাগের বেশী মানুষ।
এলাকাবাসী বলছেন, লবণ পানির প্রভাবে চর্মরোগ, কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগ বাড়ছে। ক্ষেতে ফসল ফলে না। গো-খাদ্যের চরম সংকট চলছে। চিংড়ি চাষেও দেখা দিয়েছে মন্দা।
সূত্র মতে, লবণাক্তপানির জন্য নারীদের অকাল গর্ভপাত ঘটছে ফলে কমছে না জনসংখ্যা। জাতীয়ভাবে জন্মের হার ১.৫৯ শতাংশ হলেও এই এলাকার জন্মের হার ১ শতাংশের নিচে। ২০০১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুয়ায়ী শ্যামনগর উপজেলার জনসংখ্যা ছিলো ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৮১ জন। এর মধ্যে নারী ১লাখ ৫৩ হাজার ৪৮৭ জন এবং পুরুষ১ লাখ ৬০ হাজার ২৯৪ জন। ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য বলছে, ৩ লাখ ১৮ হাজার ২৫৪ জন। এরমধ্যে নারী ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮১৩ এবং পুরুষ ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৪১ জন। শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান এ তথ্য জানান। গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগেয়ালীনি মুন্সীগঞ্জ, রমজাননগর ও কৈখালী ইউনিয়নের মানুষ নদীতে মাছ ধরে এবং বনের মধু আহারণ ও কাঠ কেটে সংসার চালাতো। নোনা পানির কারণে গাছপালা জন্মায় না। জমিতে ধান-পাট হয় না। ফলে মানুষ বেকার হয়ে পড়ছেন।’পদ্মপুকুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান এ্যড: আতাউর রহমান বলেন, ‘আইলার আট বছর পরও এলাকায় সুপেয় পানির সংকট কাটেনি। রেশনিংয়ের মাধ্যমে কিছু মানুষ খাবার পানি পেলেও চাহিদার তুলনায় তা অনেক কম। পুকুরের পানিই একমাত্র ভরসা। অনেক দূরে স্থাপিত ফিল্টারগুলোতেও (পিএসএফ) অসম্ভব ভিড় তাছাড়া শতকরা ৮০% পানির ফিল্টার অকেজে হয়ে পড়ে আছে। দূরের ফিল্টার থেকে এক কলস পানি আনতেই একবেলা কেটে যায় এই সমস্ত এলাকার মানুষের।গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, ‘চিংড়ি চাষের কারণে জমিতে কোনও ফসল ফলে না। জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন ফলজ গাছ মারা যাচ্ছে। জমিতে ধান, পাট, শাকসবজি চাষ না হওয়ায় সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। মাঠে ঘাস না জন্মানোয় গবাদিপশু পালন বন্ধ হয়ে গেছে। এলাকায় কাজ না থাকায় বউ-ছেলে-মেয়ে সংসার ফেলে শতশত মানুষ গ্রাম ছেড়েছেন।
একই গ্রামের ইউপি সদস্য আঃ মান্নান বলেন, ‘লবণ পানির কারণে চর্মরোগ লেগেই থাকে। এখানে গোসলের পানিরও সমস্যা। প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে পুকুরের পানি পান করতে হয়। চাকরিজীবীরা তাদের উপার্জনের বড় একটা অংশ বোতলজাত পানি কিনতে ব্যয় করেন।’
শ্যামনগর ও কয়রা এলাকার জলবায়ু পরিষদের সমন্বয়কারী ও সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত দৈনিক দক্ষিণের মশাল পত্রিকার সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, ‘পুকুর সংস্কার এবং ফিল্টার (পিএসএফ) মেরামতের অভাবে এই এলাকায় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। লবণ পানির কারণে এই অঞ্চলের মানুষের কর্মক্ষতা কমে যাচ্ছে। নারীদের গর্ভপাতের মতো ঘটনা ঘটছে। গত ১০ বছরে এই এলাকায় জনসংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি। কাজের সন্ধানে পুরুষরা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। ফলে বেড়েছে নারীর সংখ্যা।’
বুড়িগোয়ালীনি ইউপি চেয়ারম্যান ভবতোষ মন্ডল বলেন,‘লবন পানির কারণে এলাকায় কাজ নেই। ফলে কাজের সন্ধানে পুরুষরা এলাকা ছাড়ছেন। নারীরাও প্রতিদিন খাবার পানির তাগিদে গ্রাম থেতে গ্রাম ছুটে বেড়াচ্ছে।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সের টিএইচএ অজয় কুমার সাহা জানান, ‘বেশিরভাগ নারী চুলকানি, প্রসাবে জ্বালাপোড়া, গায়ে ব্যথা, বিভিন্ন মেয়েলি সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। লবণ পানির কারণেই যে নারীদের গর্ভপাত হচ্ছে-এটি গবেষণা ছাড়া বলা সম্ভব না। তবে সম্প্রতি এই এলাকার নারীদের গর্ভপাত বেশি হচ্ছে। ’
সাতক্ষীরার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী গতকাল প্রতিবেদককে জানান, উপকূলীয় এলাকার মানুষের সুপেয় পানির সুবিধা নিশ্চিত করতে ৬০টি পুকুর সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুজর গিফারী বলেন, ‘সুপেয় পানির সংকট নিরসনে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুপেয় পানির জন্য গভীর নলকূপ ও পানির বড় ট্যাংকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে তারা বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারে। পুকুর কেটে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের জলবায়ু ট্রাস্টের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটির মাধ্যমে বৃষ্টির পানি ধরে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘আইলার পর কয়েক বছর পানি সংকটসহ বিভিন্ন কারণে অনেক মানুষ এলাকা ছেড়েছেন। বর্তমানে আর কেউ এলাকা ছাড়ছেন না। তবে এ এলাকায় কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ করা গেলে যেসব মানুষ এলাকা ছেড়ে গেছেন, তারা আবারও ফিরে আসবেন। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’ লবণ পানিতে কাজ করার কারণে নারীদের গর্ভপাত হচ্ছে, এমন কোনও বিষয় তার জানা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতে উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। প্রাণ হারান ১০৯ জন মানুষ। তার মধ্যে কেবল সাতক্ষীরার গাবুরা ও পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ ও আশাশুনির প্রতাপনগরে মারা যায় ৭৩ জন নারী, পুরুষ ও শিশু। এব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা ০৪আসনের এমপি এস.এম জগলুল হায়দার বলেন,আইলা-সিডর, বুলবুল কবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থদের পর্নবাসনের জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। সুপেয় পানি সংকটের বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সাথে দেখছে এবং বিভিন্ন এন,জিওসহ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর মাধ্যমে অতি দ্রুত এটি নিরসন করার জন্য গভীর-অগভীর নলকুপ,পিএসএফ,বর্ষার পানি সংরক্ষণ রেইন ওয়াটার,প্লাস্টিক ট্যাংক সরবরাহের জন্য কয়েকশত কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।